রোববার (২ অগাস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১–এ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে। গত বছরের জুলাই ও আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের এক বছরের মাথায় এই মামলার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হলো।
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন ও মামলা প্রক্রিয়া
গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম শুনানি হয়েছিল ১৭ অক্টোবর। ওইদিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।
২০২৪ সালের ১২ মে তদন্ত সংস্থা এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপর ১ জুন রাষ্ট্রপক্ষ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে।
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক। তাদের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। অভিযোগ গঠন ও আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর এ তিনজনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়।
একমাত্র গ্রেপ্তার হওয়া আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ইতিমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন। তিনি এই মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে স্বীকৃত, অর্থাৎ দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্য বিবরণ প্রকাশ করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য
বিচার কার্যক্রমের শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন,
“বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিস্ট শাসক বেড়েছে এবং অনেকেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। জুলাই বিপ্লবে ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ৩৬ দিনে গুলি করে ৩০ হাজার মানুষকে পঙ্গু করা হয়েছে, প্রায় ২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চায়। আগামী প্রজন্মের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে খুনের রাজনীতি বন্ধ হয়।”
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন,
“শেখ হাসিনা তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, নির্বাহী প্রধান, আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৪–দলীয় জোটের নেত্রী। সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। একনায়কতান্ত্রিক শাসক হিসেবে সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এককভাবে নিতেন। তার অধীন কর্মকর্তারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নে সর্বদা আগ্রহী ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার বিচার শুরু করা।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আসাদুজ্জামান খান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আন্দোলন দমন ও নীতি নির্ধারণে ‘কোর কমিটি’ বৈঠকে যুক্ত ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আইজিপি হিসেবে এই বাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন এবং হামলার কার্যক্রম তদারকি করতেন।
শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন যৌথ অপরাধমূলক পরিকল্পনা ও সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের মাধ্যমে তাদের অধীন বাহিনী ও দলের সশস্ত্র ক্যাডারদের দিয়ে দেশব্যাপী প্রাণঘাতী হামলার নির্দেশ দেন। এর ফলে ১,৪০০-এর বেশি নিরপরাধ ও নিরস্ত্র ছাত্র আন্দোলনকারী নিহত হন। প্রসিকিউশন ১১টি প্রতীকী ঘটনার ওপর মামলা কেন্দ্রীভূত করবে।
সাক্ষীর বয়ান: খোকন চন্দ্র বর্মণ
মাইক্রোবাসচালক খোকন চন্দ্র বর্মণ প্রথম সাক্ষী হিসেবে জানান,
“গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিই। পরদিন নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড় থেকে চাষাঢ়া যাওয়ার পথে বিজিবি ক্যাম্পের সামনে পুলিশ ও বিজিবি গুলি চালায়। একজন নিহত হয়, আরও অনেকে আহত হয়। ৫ আগস্ট সকাল ৯টা–সাড়ে ৯টার দিকে আন্দোলনে যোগ দিতে সাইনবোর্ডে যাই। দুপুরে যাত্রাবাড়ী পৌঁছালে দেখি পুলিশ গুলি করছে। একজন মারা যায়। সেনাবাহিনী ফাঁকা গুলি করলে পুলিশ থানার ভেতরে চলে যায়। পরে পুলিশ বের হয়ে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আমি ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের পেছনে লুকাই, তবে গুলিতে আমার হাত, পা ও শরীর আহত হয়। ড্রামের পেছনে আশ্রয় নিলে পুলিশ মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলির আঘাতে আমার বাঁ চোখ, নাক ও মুখ বিকৃত হয়েছে। চিকিৎসার জন্য আমাকে রাশিয়ায় পাঠানো হয় এবং অস্ত্রোপচার করা হয়।”
খোকন চন্দ্র বর্মণ অভিযোগ করেন,
“হাজার হাজার মানুষ হত্যার জন্য শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান, ওবায়দুল কাদের, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও শামীম ওসমান দায়ী। তাঁদের বিচার চাই।”
শেখ হাসিনার বিচার শুরু দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল নিশ্চিত করছে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সমস্ত প্রমাণ গ্রহণযোগ্যভাবে যাচাই হবে। রাষ্ট্রপক্ষ, সাক্ষী এবং আদালতের কার্যক্রমের মাধ্যমে বিচারিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলা শুধু নির্যাতিতদের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করবে না, বরং ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় সহিংসতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি স্থাপন করবে। আদালতের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক আইনের মান বজায় রাখা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি ইতিহাসগঠনমূলক পদক্ষেপ হিসেবে রূপ নেবে।


