- বিগত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ৪০ শতাংশ লুটপাট।
- রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ, এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ অপচয়ের অভিযোগ।
- অপ্রতিযোগিতামূলকভাবে ঠিকাদারি বরাদ্দ, প্রকল্পের খরচ ফুলিয়ে দেখানো, এবং মানহীন কাজের তথ্য উঠে এসেছে।
- নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্রে প্রকাশিত বিস্তারিত চিত্র।
ঢাকা, ডিসেম্বর ০২,২০২৪: আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত লুটপাট এবং অপচয়ের অভিযোগ উঠেছে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শ্বেতপত্রে এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
শ্বেতপত্র অনুযায়ী, ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের মাধ্যমে অপচয় হয়েছে। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন কমিটি এই শ্বেতপত্র প্রণয়ন করেছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “উন্নয়ন প্রকল্পে আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে এবং প্রভাবশালীদের লাভবান করেছে।”
‘প্রেস্টিজ’ প্রকল্পের নামে নয়ছয়
বিগত সরকারের সময়ে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষত, অনেক প্রকল্প শুধু নামেই উন্নয়নশীল হলেও বাস্তবায়নে তা কার্যকারিতা প্রমাণে ব্যর্থ। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্প ব্যয়ের দিক থেকে বিশাল হলেও এর সুফল পায়নি জনগণ।
হবিগঞ্জের বাল্লা স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে ৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় হলেও ভারতের সীমান্তে কার্যকর স্থলবন্দর না থাকায় এটি একপ্রকার অকার্যকর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পে ৩৯ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করে মাত্র ১০টি রেল চালানো হচ্ছে, যা এর বিশাল ব্যয়ের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সাত তারকা মানের অতিথিশালা নির্মিত হলেও সেটি এখন পরিত্যক্ত। এছাড়া, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের খরচ ৫১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এটি পরিকল্পনায় ত্রুটি এবং দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়, যা জনগণের অর্থের অপচয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ।
কাজ না করেই বিল উত্তোলন
শ্বেতপত্রের তথ্য অনুযায়ী, উন্নয়ন প্রকল্পে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ঠিকাদারদের কাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা ব্যাপক অনিয়মের জন্ম দিয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঠিকাদাররা অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দিয়ে কাজের বরাদ্দ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কিছু প্রকল্পে কাজ সম্পূর্ণ না করেই বিল উত্তোলনের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষত, রেলের উন্নয়ন প্রকল্পে এমন নজির দেখা গেছে, যেখানে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছিল। তবে, প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি, অথচ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।
এই ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম শুধু উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে না, বরং জনগণের অর্থের অপচয়ের একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরছে। শ্বেতপত্রে এইসব ঘটনার তদন্ত ও দায়ীদের জবাবদিহির আহ্বান জানানো হয়েছে।
লাগামহীন দুর্নীতি
শ্বেতপত্র অনুসারে, বিগত সরকারের সময়ে ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত অর্থ অপচয় হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে এই পরিমাণ ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার সমান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারত।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, “রাজনৈতিক চাপে অনেক প্রকল্পের খরচ ফুলিয়ে দেখানো হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।”
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, মন্ত্রী, এমপি এবং প্রভাবশালী আমলারা নিজের এলাকার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। এসব প্রকল্পে জনগণের তেমন উপকার না হলেও, রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে এবং ব্যক্তিগত লাভের জন্য এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।
এডিপি: ১০ গুণ বৃদ্ধি, ফলাফল শূন্য
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এডিপির আকার ১০ গুণ বৃদ্ধি পায়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকায়।
কিন্তু এই ব্যয় কেবলমাত্র অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে শেষ হয়েছে, যা জনগণের অর্থের অপচয়ের বড় উদাহরণ।
সংস্কারের প্রতিশ্রুতি
নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শ্বেতপত্রে উত্থাপিত দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সরকার উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও করেছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সংস্কার কমিটি জানিয়েছে, ভবিষ্যতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ উদ্যোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে অপচয় রোধে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কমিটির মতে, উন্নয়ন প্রকল্পে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কার্যক্রম নিশ্চিত করা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছানো জরুরি।
ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি কি সম্ভব!
শ্বেতপত্রে উত্থাপিত তথ্য দেশের অর্থনৈতিক দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। উন্নয়নের নামে জনগণের করের অর্থ লুটপাট ও অপচয় কেবল অর্থনীতির ক্ষতিই করেনি, বরং দেশের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করেছে। এ ধরনের অপব্যবস্থাপনা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
প্রশ্ন হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব দুর্নীতি তদন্তে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জনগণের টাকায় পরিচালিত প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়ে গেছে।
দেশবাসী দৃষ্টি রাখছে শ্বেতপত্রে উত্থাপিত দুর্নীতি তদন্তে সরকার কী পদক্ষেপ নেয় এবং কীভাবে জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি করে। সরকারের সদিচ্ছাই পার্থক্য গড়ে দেবে এবং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।