ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের মানবাধিকার-বিষয়ক উপকমিটি তাদের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের ওপর ভিত্তি করে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবনতি হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে হাঁটছে। এই উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। গত বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদর দপ্তরে এই প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক রূপান্তর চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচার ব্যবস্থা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের জন্য কাজ শুরু করেছে, যা প্রশংসনীয়। তবে, এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বিশেষ করে শ্রম অধিকার এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য আরও অগ্রগতি প্রয়োজন। এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
প্রতিনিধি দলের প্রধান মৌনির সাতৌরি জানান, তাঁদের সফরের প্রধান দুটি উদ্দেশ্য ছিল: প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা; এবং দ্বিতীয়ত, প্রায় ভুলতে বসা রোহিঙ্গা সংকটকে পুনরায় ইইউর রাজনৈতিক এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা। তিনি বলেন, ইউক্রেন ও গাজা সংকটের কারণে বিশ্ব যখন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে, তখন রোহিঙ্গাদের বিষয়টি যাতে হারিয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য ইজাবেল উইসেলার-লিমা বলেন, সামনে বাংলাদেশে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে বলে তিনি আশাবাদী। অন্যদিকে, সদস্য আরকাদিউজ মুলারজিক মুসলিম বিশ্বের কিছু অংশের উদাসীনতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ইউরোপীয় দেশগুলোই রোহিঙ্গা শিবিরে সবচেয়ে বেশি মানবিক সহায়তা দিচ্ছে, যখন মুসলিম দেশগুলোর তরফ থেকে সমর্থন নগণ্য। তিনি এই বিষয়টিকে ‘আশ্চর্যজনক এবং গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্যাটারিনা ভিয়েরা মন্তব্য করেন, দেশটি একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা সত্যিকারের অগ্রগতির একটি সুযোগ। তিনি উল্লেখ করেন, একটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বের দাবি নয়, বরং এটি নাগরিক সমাজ, ছাত্র ও যুব সমাজেরও প্রত্যাশা।
তবে ক্যাটারিনা ভিয়েরা ধর্মীয়, লিঙ্গভিত্তিক ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং নারীদের এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ না থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারে।
উল্লেখ্য, গত ১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার উপকমিটির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সফর করে। এই সময়ে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এছাড়াও, প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে সেখানকার মানবিক পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেন। এই সফরটি এমন এক সময়ে হয়েছে যখন ইইউ এবং বাংলাদেশ একটি নতুন অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি (PCA) নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে এবং জিএসপি+ সুবিধার মাধ্যমে বাজারে প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার বিষয়েও আলোচনা চলছে।


