যুক্তরাষ্ট্র বুধবার (২৭ আগস্ট) থেকে ভারতের পণ্যের ওপর ৫০% শুল্ক কার্যকর করেছে। এই পদক্ষেপটি ভারতের রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র ক্রয়ের কারণে নেওয়া হয়েছে। শুল্কের মধ্যে ২৫% অতিরিক্ত শুল্ক রয়েছে, যা রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনের জন্য আরোপিত হয়েছে। এই শুল্ক বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। ৫০% শুল্ক কার্যকরে বিপর্যস্ত ভারত প্রকট এখন অর্থনৈতিক চাপের মুখোমুখি।
ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। দেশটি এখনো রাশিয়া হতে তেল কেনার সিদ্ধান্তে পরিবর্তন করে নাই। তারা শুল্ককে অন্যায় বলেছে এবং দেশের ১৪ কোটি মানুষকে সুরক্ষা দিতে “সেরা চুক্তি” বেছে নেবার ঘোষণা দিয়েছে।
চলতি মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুল্কের প্রভাব কমাতে কর হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে বিশাল শুল্কের কারণে রপ্তানি-নির্ভর পোশাক, হিরা ও চিংড়িসহ মার্কিন বাজারমুখি অন্যান্য শিল্পে যুক্ত কোটি মানুষের জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
ভারতেরে স্বাধীনতা দিবসে জনগণের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে মোদি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং দোকানদারদের “স্বদেশী” বা “মেড ইন ইন্ডিয়া” বোর্ড স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে প্রদর্শনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমাদের গর্ব বজায় রাখতে হলে স্বাবলম্বী হতে হবে,। বিশ্বে অর্থনৈতিক স্বার্থপরতা বাড়ছে। আমাদের কষ্ট নিয়ে কাঁদতে হবে না। নিজেদের উপর ভরসা রাখতে হবে। বাইরের কোনো পক্ষকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে দেওয়া যাবে না।
একই বক্তব্য তিনি চলতি সপ্তাহে অন্তত আরও দুইবার দিয়েছেন। মোদি দেশের মানুষকে “মেড ইন ইন্ডিয়া’ অর্থাৎ ভারতে উৎপাদন করে ভারতেই-খরচ করো” আদর্শ বাস্তবায়ণ করতে বলেছেন। তবে এই আদর্শ বাস্তবায়ন করা কঠিন, কারণ ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্র ১৫% উৎপাদন শিল্পের অংশ। সরকার বছরের পর বছর বিভিন্ন প্রণোদনা এবং অনুদান দিলেও উৎপাদন বাড়েনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকা কর সংস্কার দ্রুত কার্যকর করা হলে মানুষদের হাতে বেশি টাকা পৌঁছাবে। এতে শুল্কের প্রভাব কিছুটা কমানো সম্ভব হবে। এ জন্য, বাজেটে এই বছরের শুরুতে ১২ বিলিয়ন ডলারের আয়কর হ্রাসের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে মোদি পরোক্ষ কর ব্যবস্থা সংস্কারের পরিকল্পনা করছেন। এর মধ্যে রয়েছে জিএসটির হ্রাস এবং সরলীকরণ।
জিএসটি চালু হয়েছিল আট বছর আগে। বিভিন্ন জটিল পরোক্ষ কর প্রতিস্থাপন করে ব্যবসা বান্ধব এবং নিয়ম সহজ করা হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে অনেক থ্রেশহোল্ড এবং অব্যাহতি আছে, যা সিস্টেমকে জটিল করে তুলেছে। তাই মোদি সরল দুই স্তর বিশিষ্ট জিএসটি প্রস্তাব করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জেফ্রিস ব্রোকারেজ হাউসের বিশ্লেষকরা বলেছেন, “এপ্রিল ২০২৫ থেকে আয়কর হ্রাসের সঙ্গে জিএসটি সংস্কার যুক্ত হলে এটি খরচের ক্ষেত্রে মানুষের পকেটে অস্থিরতা আনবে।” ভারতের ব্যক্তিগত খরচ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০% এর বেশি অবদান রাখে। গ্রামে ব্যায়ের হার সহনীয়, তবে শহরে চাহিদা কমেছে। এর কারণ কম মজুরি এবং করোনা পরবর্তী বেকারত্ব।
মানুষের খরচ বাড়বে, যা জিডিপি বাড়াবে এবং মুদ্রাস্ফীতি কমাবে, বলেছেন মরগ্যান স্ট্যানলি বিনিয়োগ ব্যাংকের বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে, দীপাবলির সময়ে স্কুটার, ছোট গাড়ি, পোশাক এবং সিমেন্টের মতো পণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে।
সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব মেনে নিয়েই বিশ্লেষকরা মনে করছেন কম জিএসটির কারণে রাজস্বের ক্ষতি অন্য কর এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত আয়ের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। সুইস বিনিয়োগ ব্যাংক ইউবিএস বলেছেন, এই জিএসটি হ্রাসের প্রভাব আগের আয়কর বা কর হ্রাসের চেয়ে বেশি হবে। কারণ এটি সরাসরি ক্রয় বা খরচকে প্রভাবিত করবে, যা ভোক্তাদের খরচ বাড়াবে।
মোদির কর হ্রাস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার আরও কমানোর সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। ইতিমধ্যেই তারা সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ১% হার কমিয়েছে। এটি ঋণ গ্রহণকে উৎসাহিত করবে। সরকারি কর্মচারী ও পেনশনধারীদের বেতন এবং ভারতের অর্থনীতির উন্নয়ন ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
এই ঘোষণায় ভারতের শেয়ারবাজার উচ্ছ্বসিত হয়েছে। বাণিজ্য অনিশ্চয়তার মধ্যে, এই মাসে এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল ১৮ বছরের বিরতির পরে ভারতের সার্বভৌম রেটিং উন্নীত করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে সরকার কম সুদে ঋণ নিতে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে।
মোদি দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত সংস্কার দ্রুত আনার পরও ভারতের অর্থনৈতিক পরিসর উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। বিদেশি সংকটও কমার চিহ্ন দেখাচ্ছে না। দিল্লি ও ওয়াশিংটন-এর মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা, বিশেষ করে রাশিয়া থেকে জ্বালানি ক্রয় নিয়ে, তীব্র হয়েছে। এই সপ্তাহে নির্ধারিত বাণিজ্য আলোচনাও বাতিল হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত ৫০% শুল্ক কার্যকরে বিপর্যস্ত ভারত বিশ্বের দ্রুতবর্ধমান অর্থনীতির সঙ্গে বাণিজ্য থেকে প্রায় নিষিদ্ধের মতো অবস্থায় পড়েছে। এটি এমন এক পরিস্থিতি, যা কয়েক মাস আগে কল্পনাও করা যেত না। দেশটি এখন এই প্রকট চাপ লাঘবের কৌশল অনুসন্ধান করছে।