আকীল আকতাব
রাশিয়া প্রায় তিন দশক পর আবার ফিরে গেছে পুরোনো দিনে। বৈদেশিক বাণিজ্য সচল রাখতে পণ্য বিনিময় প্রথার আশ্রয় নিচ্ছে। গমের বিনিময়ে আসছে চীনা গাড়ি। তিসি বীজের বদলে আসছে নির্মাণসামগ্রী। এমনকি ধাতু আর যন্ত্রপাতিও এখন টাকার পরিবর্তে পণ্য দিয়ে লেনদেন হচ্ছে।
প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এটি একধরনের কৌশল। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে রাশিয়ার বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান। কিন্তু বাস্তবে পণ্য বিনিময় প্রথায় ফেরা শক্তির প্রতীক নয়। এটি অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতার প্রকাশ। এই প্রত্যাবর্তন দেখিয়ে দিচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা কীভাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সম্পদ রপ্তানিকারক দেশটির বাণিজ্য কাঠামোতে চাপ সৃষ্টি করেছে।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল আর ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়ার ওপর চাপানো হয়েছে ২৫ হাজারেরও বেশি নিষেধাজ্ঞা। রুশ ব্যাংকগুলোকে সুইফট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ডলার ও ইউরো লেনদেনে এসেছে বাধা। এদিকে চীনা ব্যাংকগুলোও দ্বিতীয় ধাপের নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে পড়েছে।
ক্রেমলিন বলছে, তাদের অর্থনীতি ভালো করছে। জি৭ দেশগুলোর চেয়ে রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি দ্রুত হচ্ছে। কিন্তু সরকারি তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কমছে। মুদ্রাস্ফীতি আট শতাংশের ওপরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও স্বীকার করছে অর্থনীতি “প্রযুক্তিগত মন্দায়” আছে। এই পরিস্থিতিতেই ফিরিয়ে আনা হয়েছে পণ্য বিনিময় প্রথা। প্রচলিত আর্থিক লেনদেন অসম্ভব হয়ে পড়ার কারণেই এই কৌশলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
অনেকে বলছেন, এই কৌশল রাশিয়াকে সাহায্য করছে। ডলারভিত্তিক ব্যবস্থা এড়িয়ে চীন বা ভারতকে সঙ্গে নিয়ে লেনদেন সম্ভব হচ্ছে। রাশিয়ার অর্থনীতি মন্ত্রণালয় কীভাবে বিদেশি পণ্য বিনিময় লেনদেন সাজাতে হবে তা নিয়ে ১৪ পাতার নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে।
প্রকৃতপক্ষে যে কোনো উপায়ে টিকে থাকার কৌশলকে সুস্থ অর্থনীতির বিকল্প ভাবা ভুল। পণ্য বিনিময় প্রথা অকার্যকর ও অস্বচ্ছ। সহজেই জন্ম দেয় দুর্নীতি। গম আর গাড়ির বিনিময়মূল্য ঠিক করা সহজ নয়। তাতেই আসে বিকৃতি। ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার শুল্ক বিভাগ আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাণিজ্য পরিসংখ্যানের মধ্যে সাত বিলিয়ন ডলারের ফারাক।
১৯৯০-এর দশকের প্রতিধ্বনি বর্তমান সময়ে আবার স্পষ্ট হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার সাথে সাথে ভেঙে পড়েছিল মুদ্রার প্রতি আস্থা। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ফলে তৈরি হয়েছিল বিশাল এক পণ্য বিনিময় নির্ভর অর্থনীতি। এই অর্থনীতি একই সাথে ছিল জটিল, প্রতারণাপূর্ণ আর অনিশ্চিত।
আজ রাশিয়া দেউলিয়া নয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও আছে। কিন্তু পশ্চিম শক্তি অর্থনীতিকে অস্ত্র বানিয়েছে। রাশিয়া পাল্টা অস্ত্র বানিয়েছে জ্বালানিকে। অথচ এখন চাপের মুখে রাশিয়ার স্বাভাবিক বাণিজ্যই বদলে যাচ্ছে।
ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করছেন, নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু পণ্য বিনিময় প্রথা ঠিক তার উল্টো বার্তা দিচ্ছে। এটি শক্তির নয়, মরিয়া অবস্থার প্রতীক। যেমন কেউ ব্যাংক কার্ড নিতে অস্বীকৃতি জানালে নগদ গুনে হিসাব চুকিয়ে আসে।
এ কথা সত্য যে, পণ্য বিনিময় প্রথা রাশিয়াকে চীনের যন্ত্রপাতি কিনতে আর শস্য রপ্তানি অব্যাহত রাখতে সাহায্য করছে। কিন্তু একই সঙ্গে এই কৌশলের ওপর নির্ভরতা দেখাচ্ছে যে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার সঙ্গে রাশিয়ার সংযুক্তি ভেঙে পড়ছে। ফলে ক্ষতি শুধু রাজস্বের নয়, ক্ষতি হচ্ছে আধুনিকায়নেরও। পণ্য বিনিময় প্রথা প্রতিযোগিতা তৈরি করে না, বরং তা ক্ষয় করে। এতে টিকে যায় শুধু প্রভাবশালী কোম্পানি। নতুন উদ্ভাবন নিরুৎসাহিত হয়।
পণ্য বিনিময় প্রথার পুনরুত্থান পশ্চিমের জন্যও সতর্কবার্তা। নিষেধাজ্ঞা শক্তিশালী অস্ত্র হলেও এর ফল সব সময় পরিষ্কার নয়। নিষেধাজ্ঞার চাপ স্বাভাবিক অর্থনীতিকে অপ্রত্যাশিতভাবে বদলে দেয়। রাশিয়া এখন গড়ছে সমান্তরাল ব্যবস্থা। পণ্য বিনিময়, ক্রিপ্টো এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক লেনদেন ধীরে ধীরে ডলারভিত্তিক ব্যবস্থার বিকল্প তৈরি করছে।
বিশ্ব হয়তো পুরোপুরি ১৯৯০-এর দশকে ফিরছে না। কিন্তু এগোচ্ছে বিভক্ত বাস্তবের দিকে। যেখানে পণ্য বিনিময়, ক্রিপ্টো আর দ্বিপাক্ষিক চুক্তি দাঁড়াচ্ছে প্রচলিত অর্থব্যবস্থার পাশে। এটি স্থিতিশীলতা নয়। বরং বৈশ্বিক বাণিজ্যের মূল ভিত্তি—আস্থা ও স্বচ্ছতার ক্ষয়।
আমার দৃষ্টিতে, রাশিয়ার এই পণ্য বিনিময় প্রথায় ফেরা কোনো চতুর রাষ্ট্রনীতি নয়। এটি পশ্চাদপদতার প্রকাশ। এক সতর্কবার্তা যে নিষেধাজ্ঞা অর্থনীতিকে কীভাবে বিকৃত করে। মস্কোর জন্য এটি রক্তপাতের ওপরে ব্যান্ডেজ। পশ্চিমের জন্য এটি মনে করিয়ে দেওয়া উচিত যে আর্থিক বিচ্ছিন্নতা শুধু টার্গেট দেশ নয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যকেও ভেঙে দেয়।
পণ্য বিনিময় প্রথায় ফিরে যাওয়া স্থিতিশীলতার প্রতীক নয়। এটি প্রমাণ করে যে, যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলা করতে রাশিয়া আবার সেই পুরোনো পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল।
.
আকীল আকতাব, পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক।


