গত বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রিয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের আলিঙ্গন শুধু একটি প্রথাগত সৌজন্যতা ছিল না, এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে। সেই সময়ই ঘোষণা করা হয় সৌদি-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি। এই চুক্তির ফলে পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের সম্পর্ক উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের আরও ঘনিষ্ঠ হলো।
সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন, এই চুক্তি কেবল দীর্ঘদিনের সহযোগিতাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। তবে ভারতের কাছে বিষয়টি ভিন্ন।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। এ বছরের শুরুতে দুই দেশের মধ্যে চার দিনের যুদ্ধও হয়েছিল। কাশ্মীর নিয়ে একাধিক যুদ্ধ ও সংঘর্ষের ইতিহাস রয়েছে। তাই পাকিস্তানকে সামরিকভাবে সমর্থন দেওয়ার সৌদি পদক্ষেপকে ভারত সরাসরি নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচেনা করছে। বিশেষ করে চুক্তির “যে কোনো এক দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন মানে উভয়ের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ধরা হবে” ধারাটি ভারতীয় বিশ্লেষকদের সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে।
ভারতীয় কৌশল বিশেষজ্ঞ ব্রহ্মা চেল্লানি এক এক্স পোস্টে লিখেছেন, সৌদি আরব জানত ভারত এটিকে হুমকি মনে করবে, তবু তারা এগিয়েছে। তার মতে, এটি পাকিস্তানের শক্তি নয়, সৌদির উচ্চাকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও সৌদি আরব তাকে কাজে লাগাচ্ছে জনশক্তি ও পারমাণবিক “বীমা” হিসেবে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব কানওয়াল সিবাল এই পদক্ষেপকে “গুরুতর ভুল” বলেছেন। তার মতে, রাজনৈতিকভাবে অস্থির ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পাকিস্তানকে নিরাপত্তা সহযোগী বানানো বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত।
ভারত সরকার অপেক্ষাকৃত সংযমী ভূমিকা প্রদর্শন করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে খতিয়ে দেখবে। ভারত আশা করছে, সৌদি তাদের কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ ও সংবেদনশীলতাও বিবেচনা করবে।
ঝুঁকির বিষয়ে সব বিশ্লেষক আবার গভীর উদ্বিগ্ন নন। তাদের মতে, দিল্লি হয়তো ঝুঁকিকে বড় করে দেখছে। সৌদি আরব ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং সৌদি তেলের অন্যতম প্রধান ক্রেতা হলো ভারত।
পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, চুক্তি সরাসরি ভারতের জন্য বাধা নয়। সৌদির ভারতের সঙ্গে বিস্তৃত সম্পর্ক আছে, তাই তারা ভারতের বিরুদ্ধে বৈরী পদক্ষেপ নেবে না। তবে পাকিস্তানকে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করে ভারতকে কৌশলগতভাবে চাপে ফেলা হয়েছে। পাকিস্তান এখন চীন, তুরস্ক ও সৌদি অর্থাৎ তিন শক্তির সমর্থন পাচ্ছে।
ক’জন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এর মূল তাৎপর্য সরাসরি হুমকি নয়, বরং আঞ্চলিক জোট ও ভারসাম্যের পরিবর্তন।
সাবেক পাকিস্তানি কূটনীতিক হুসেইন হক্কানি বলেন, এই চুক্তি সৌদিকে হয়তো সেই ভূমিকায় ফেলবে যা ঠান্ডা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পালন করেছিল, অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে পাকিস্তানকে ভারতের মোকাবেলায় সহায়তা করা।
তিনি সতর্ক করেছেন, এতে ভারতের সঙ্গে সৌদির অর্জিত অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কও চাপের মুখে পড়তে পারে।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মুদ্দাসসির ক্বামারের মতে, এটি নতুন কিছু নয়। ১৯৬০-এর দশক থেকেই সৌদি–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বিদ্যমান। মক্কা মসজিদ দখলকাণ্ডে পাকিস্তানি কমান্ডোরা সৌদিকে সাহায্য করেছে। সৌদি পাকিস্তানি অস্ত্র কিনেছে, অফিসারদের ব্যবহার করে বিমান বাহিনী গড়েছে, এমনকি ২০১৭ সালে একজন অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি জেনারেলকে আইএসবিরোধী জোটের প্রধান করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর আস্থা কমে যাওয়াই সৌদির বড় কারণ। সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলা ও ইরানের সঙ্গে দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৌদিকে ভাবাচ্ছে যে শুধু ওয়াশিংটনের ওপর ভরসা যথেষ্ট নয়।
চাটাম হাউসের গবেষক আহমেদ আবুদৌহ বলেন, এই চুক্তির আসলে বার্তা হলো সৌদি নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব বৈচিত্র্যময় করছে। তিনি মনে করেন, সৌদি এখন ইরান ও ইসরায়েল উভয়কেই হুমকি হিসেবে দেখছে এবং পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তিকে প্রতিরোধের অংশ করতে চাইছে।
ভারতের জন্য এটি সরাসরি সামরিক হুমকি নয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে কূটনৈতিক ঝুঁকি আছে। যদি এ জোট বিস্তৃত হয়ে “ইসলামিক ন্যাটো”-র মতো আকার নেয়, তবে ভারতের পশ্চিমমুখী কৌশল— অর্থনীতি, বাণিজ্য ও কৌশলগত করিডর আরও জটিল হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে পাকিস্তান সৌদির আর্থিক শক্তি কাজে লাগিয়ে সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে পারবে। একই সাথে সৌদির রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে আরও সমর্থন পেতে পারে। ফলে ভারতকে শুধু পাকিস্তান নয়, বৃহত্তর মুসলিম জোটেরও মোকাবিলা করতে হতে পারে।
কুগেলম্যান মনে করেন, এতে আঞ্চলিক ভারসাম্য পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে। ভারত রাশিয়া, ইসরায়েল, উপসাগরীয় দেশ ও ফ্রান্সের মতো অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকলেও পাকিস্তান নতুন শক্তি অর্জন করছে।
সৌদি-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তির কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের নিরাপত্তার বড় কোনো হুমকি নেই। তবে কূটনৈতিক দিক থেকে এটি দিল্লির জন্য ভালো বার্তা নয়। পরিস্থিতি কীভাবে বদলাবে, তা এখনো সময়ই বলে দেবে।
.
বিবিসি প্রতিবেদন অনুসারে INFORMER365 | বাংলার পাঠকদের জন্য লিখেছেন আকীল আকতাব।


