বাইরে থেকে দেখলে এদের সাধারণ ঘোড়ার ছানার মতোই লাগে। স্বভাবে শান্ত, গাঢ় বাদামি রঙের কোট, মুখে সাদা ছোপ। দিন কাটে গ্রামাঞ্চলে ঘেরা মাঠে ঘাস চিবিয়ে। কিন্তু এরাই হলো বিশ্বের প্রথম জিন-সম্পাদিত ঘোড়া। মাত্র ১০ মাস বয়সী এই পাঁচ শাবক হলো পুরস্কারজয়ী ঘোড়া পোলো পুরেসা (Polo Purity)-এর ক্লোন, যার ডিএনএ-তে CRISPR প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি পরিবর্তিত সিকোয়েন্স যুক্ত করা হয়েছে। এই জিন সম্পাদনার লক্ষ্য হলো বিস্ফোরণ-গতি নিশ্চিত করা।
আর্জেন্টিনার কেইরন বায়োটেক (Kheiron Biotech) বিশ্বের প্রথম জিন-সম্পাদিত (genetically edited) ঘোড়াগুলো তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, প্রজননে বিপ্লব আনতে পারে জিন-সম্পাদিত ঘোড়া। ক্লোনিং কেবল জেনেটিক অনুলিপি তৈরি করে, কিন্তু CRISPR এক ধরনের জেনেটিক কাঁচি। এই প্রযুক্তি ডিএনএ কেটে নতুনভাবে সাজিয়ে ফেলে। CRISPR এর পূর্ণরূপ হলো Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats, এটি ব্যাকটেরিয়ার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত, যেখানে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের ডিএনএ চিনে এবং তাকে কেটে ধ্বংস করে।
কেইরন কোম্পানি মায়োস্ট্যাটিন (myostatin) জিনের কার্যকারিতা কমাতে CRISPR ব্যবহার করেছে, যা পেশি বৃদ্ধিকে সীমিত করে। উদ্দেশ্য হলো পেশির ফাইবার বাড়ানো, যাতে শক্তিশালী ও দ্রুত গতির দৌড় সম্ভব হয়। অর্থাৎ এই ঘোড়াগুলোকে পরিণত করা হবে স্প্রিন্টারে।
পোলোতে বাধা
বিশ্বের পোলো রাজধানী হিসেবে পরিচিত আর্জেন্টিনা বহু বছর ধরেই ক্লোনিংসহ বিভিন্ন প্রজনন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু আর্জেন্টাইন পোলো অ্যাসোসিয়েশন এবং প্রজননকারীদের সমিতি জিন-সম্পাদিত ঘোড়াগুলোকে খেলায় অংশগ্রহণে করতে দিচ্ছে না।
আর্জেন্টাইন পোলো অ্যাসোসিয়েশন স্পষ্টভাবে জিন সম্পাদনা করা ঘোড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বেঞ্জামিন আরায়া বলেছেন,
“আমি চাই না এরা পোলো খেলুক। এতে ঘোড়া প্রজননের আকর্ষণ, সেই জাদু হারিয়ে যাবে। আমি একটি মাদি ও একটি পুরুষ ঘোড়া বেছে নিই, তাদের ক্রস করি এবং আশা করি ভালো কিছু জন্ম নেবে—এই রোমাঞ্চই আসল।”
প্রজননকারীদের সমিতি জানিয়েছে, সিদ্ধান্ত নিতে চার থেকে পাঁচ বছর এই ঘোড়াগুলো পর্যবেক্ষণ করবে।
কেইরন অবশ্য আত্মবিশ্বাসী। কোম্পানির বৈজ্ঞানিক পরিচালক গ্যাব্রিয়েল ভিসেরা বলেছেন,
“আমি খুব বেশি চিন্তিত নই। আমাদের কাজ এখন শিক্ষা দেওয়া ও ব্যাখ্যা করা। সময়ের সঙ্গে সবাই মানিয়ে নেবে।”
সমস্যা হলো এই নিষেধাজ্ঞা কীভাবে কার্যকর হবে তা অস্পষ্ট। আর্জেন্টিনার আইনে ক্লোন, জিন-সম্পাদিত বা প্রচলিত প্রজনন করা ঘোড়ার মধ্যে পার্থক্য করা হয় না।
প্রজননকারীদের দুশ্চিন্তা
অনেক প্রজননকারী বলছেন, ক্লোনিং রক্তধারা (bloodline) টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হলেও জিন-সম্পাদনা সীমা অতিক্রম করছে, যা তাদের ব্যবসার জন্য হুমকি।
প্রাক্তন পেশাদার পোলো খেলোয়াড় ও প্রজননকারী মার্কোস হেগুই বললেন,
“এটা প্রজননকারীদের ধ্বংস করে দেবে। যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ছবি আঁকা, তাহলে শিল্পীর আর দরকার কী?”
আরেক প্রজননকারী এদুয়ার্দো রামোস মনে করিয়ে দিলেন, ৭০-এর দশকে যখন ভ্রূণ প্রতিস্থাপন বা ক্লোনিং শুরু হয়েছিল, তখনও অনেকেই বিরোধিতা করেছিলেন।
“বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এগিয়ে যাবে। যারা বলে এটা করা উচিত নয়, তারা থামাতে পারবে না।”
আর্জেন্টিনার পোলো ঐতিহ্য
মধ্য এশিয়ায় জন্ম নেওয়া পোলো ব্রিটিশ অভিবাসীদের হাত ধরে ১৮৮২ সালে আর্জেন্টিনায় পৌছায়। এটি ঘোড়সওয়ার হকির মতো খেলা, যেখানে দুটি দলের চারজন করে খেলোয়াড় লম্বা ম্যালেট দিয়ে বল ঠেলে গোলপোস্টে পাঠায়।
খেলাটি ব্যয়বহুল। একজন খেলোয়াড়কে প্রতি ম্যাচে প্রায় এক ডজন ঘোড়া চালাতে হয়। আর্জেন্টিনায় ঐতিহ্যগতভাবে ভূস্বামী ও ধনী পরিবারগুলোই এ খেলায় অংশ নেয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আর্জেন্টিনা ২,৪০০ পোলো ঘোড়া রপ্তানি করেছে। পোলো ঘোড়ার জাত কুইন’স কাপ (ইংল্যান্ড) ও আর্জেন্টাইন ওপেন এর মতো মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্টে আধিপত্য করছে।
পোলো দীর্ঘদিন ধরে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন এবং ক্লোনিং মেনে নিয়েছে। এমনকি ঘোড়দৌড়ের বিপরীতে এখানে ক্লোন ঘোড়ার অংশগ্রহণ বৈধ।
ক্লোনের বাণিজ্যিক সাফল্য
বিশ্বের প্রথম ক্লোন ঘোড়া জন্মেছিল ২০০৩ সালে। কিংবদন্তি খেলোয়াড় আদলফো কেম্বিয়াসো পোলো ক্লোনকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ২০১০ সালে তার বিখ্যাত ঘোড়া কুয়ার্তেতেরা-র ক্লোন নিলামে ৮ লাখ ডলারে বিক্রি হয়। ঘটনাটি তরুণ গবেষক ভিসেরার দৃষ্টি কেড়েছিল।
এরপর ভিসেরা ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল সামার্তিনোর সহায়তায় ২০১১ সালে কেইরন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সালে জন্ম নেয় তাদের প্রথম ক্লোন ঘোড়া।
প্রথমে বাজার গড়ে তুলতে সামার্তিনো শীর্ষ প্রজননকারীদের বিনামূল্যে ক্লোনিং সেবা দেন, শর্ত ছিল কিছু ক্লোন তাদের কাছে রাখার। এখন তারা বছরে প্রায় ৪০০ ক্লোন উৎপাদন করছে—যা আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া মোট ক্লোন ঘোড়ার অর্ধেকেরও বেশি।
গড়ে প্রতিটি ক্লোন ঘোড়ার দাম ৪০ হাজার ডলার।
জিন-সম্পাদিত ভ্রূণ ও অশ্বশাবক
২০১৭ সালে কেইরন প্রথমবার CRISPR ব্যবহার করে ৯টি জিন-সম্পাদিত ঘোড়ার ভ্রূণ তৈরি করে গবেষণার জন্য। বিষয়টি আর্জেন্টিনার পোলো মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া তোলে। এরপর কয়েক বছর তারা মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে জিন-সম্পাদিত গরু ও শূকরের ভ্রূণ তৈরি করে। গত বছর সান আন্তোনিও দে আরেকো শহরে তাদের ক্লিনিকে জন্ম নেয় এই পাঁচ বাচ্চা ঘোড়া।
আর্জেন্টিনার বায়োটেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিএনএ সম্পাদনার সত্যতা যাচাই করেছে। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। প্রায় ৫০ জন প্রজননকারী চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছেন, জিন-পরিবর্তিত ঘোড়া “সীমা অতিক্রম করছে” এবং নিবন্ধনের আগে ভালোভাবে ভাবতে হবে। সমিতির সভাপতি সান্তিয়াগো ব্যালেস্তার বললেন,
“ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের সাবধান হতে হবে যে এগুলো সত্যিই কি শ্রেষ্ঠ ঘোড়া? যদি সাধারণ হয়, তাহলে এর জন্য কে টাকা দেবে?”
বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লাক ইকুইন রিসার্চ সেন্টারের জেনেটিসিস্ট টেড কালবফ্লেইশ বলেছেন, মায়োস্ট্যাটিন জিনের সম্পাদনা মূলত বহু প্রজন্ম ধরে যে পরিবর্তন আসতে পারত, তা ত্বরান্বিত করেছে।
“এখানে অনুমানভিত্তিক কিছু নয়। সুস্থ ঘোড়ায় উপস্থিত জিনকেই সঠিকভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে, তাই কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।”
তিনি মনে করেন, জিন-সম্পাদিত ঘোড়ারা পোলোতে কিছু সুবিধা পেতে পারে, তবে তা অন্যায্য নয়।
“আজকাল প্রযুক্তি গণতান্ত্রিক। যার টাকা আছে, সে-ই এটা করতে পারে।”
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
বিশ্বের প্রথম জিন-সম্পাদিত ঘোড়া কবে থেকে মাঠে নামতে পারবে তা অনিশ্চিত। সামার্তিনো স্বীকার করেছেন, পোলো কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়া পর্যন্ত জিন-সম্পাদন সেবা বাণিজ্যিকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। ডজনখানেক সম্ভাব্য গ্রাহক জিন-সম্পাদিত ঘোড়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখালেও তাদের নাম প্রকাশ করতে আগ্রহী নন জানিয়ে তিনি বলেন,
“এটা সত্যিই ভালো ঘোড়া হবে কি না, আমি জানি না। সময়ই তা বলবে।”