ভারতীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক নীতি সহায়তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ অতিরিক্ত ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বাড়াতে সক্ষম হবে।
গত ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্যে ২০ শতাংশ, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে ১৯ শতাংশ এবং ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। পরবর্তীতে, রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনার কারণে ‘জরিমানা’ হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ভারতীয় পণ্যে মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের উচ্চ শুল্কের ফলে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা একাধিক খাতে প্রতিযোগিতা হারাবে। যার মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, চামড়াজাত দ্রব্য, হিমায়িত মাছ ও চিংড়ি এবং আসবাবপত্র। এগুলো বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হওয়ায় ভারত থেকে সরে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ডারগুলো বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা পেতে পারেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে রপ্তানি আদেশ অন্যত্র সরে যাবে, আর এর বড় অংশ বাংলাদেশ পেতে পারে। সঠিক নীতিগত সহায়তা থাকলে বাংলাদেশ অতিরিক্ত ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বাড়াতে সক্ষম।”
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “ভারত থেকে কিছু অর্ডার নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে আসবে। তবে তা কাজে লাগাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে হবে, লিড টাইম কমাতে হবে এবং পরিবহন খাতে নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।”
অন্যদিকে, বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, কাস্টমসের জটিলতা এবং এনবিআর-এর অদক্ষতা সমাধান না হলে এই সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে। তার ভাষায়, “আমরা যদি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারি এবং নীতিমালা সুসংহত করি, তাহলে চলতি অর্থবছরেই রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।”
বর্তমানে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮.২ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করে, বিপরীতে আমদানি করে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অপরদিকে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি অংশীদার হিসেবে গণ্য করে। ২০২৫ সালের মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে ভারতের মোট রপ্তানি ছিল ৪৩৪ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৮৬.৫১ বিলিয়ন ডলার গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় রপ্তানিতে এত বড় ধাক্কা বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিয়েছে। তবে সুযোগ বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সরকারের সময়োপযোগী নীতি, শিল্পখাতের প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর।
ভারতীয় রপ্তানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ শুল্ক শুধু দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য সমীকরণই নয়, বরং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলেও নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। বাংলাদেশ যদি কৌশলগত দিক থেকে প্রস্তুতি নিতে পারে, তবে এ সুযোগকে টেকসই রপ্তানি বৃদ্ধির মাইলফলক হিসেবে রূপান্তর করা সম্ভব হবে।