চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনকে কেবল কূটনৈতিক বৈঠক বা সামরিক প্রদর্শনী হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি। এটি ছিল এক বহুমাত্রিক প্রদর্শনী, যেখানে কূটনীতি, সামরিক শক্তি, ঐতিহাসিক স্মৃতি এবং ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক রাজনীতির রূপরেখা একসাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শির এই কৌশল আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
গত তিন দিন ধরে চীনের ব্যস্ততম বন্দরনগরে শি জিনপিং স্বাগত জানিয়েছেন এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য অঞ্চলের দুই ডজনেরও বেশি বিশ্বনেতাকে। কূটনৈতিকভাবে এই আয়োজনের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন, চীন একটি স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসেবে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারে। তবে সফট পাওয়ারের এই প্রদর্শনীর পরই চীনের সামরিক ক্ষমতার দৃশ্যমান প্রদর্শনী শুরু হয়।
বেইজিংয়ের অ্যাভিনিউ অব ইটার্নাল পিস সড়কটি হয়ে ওঠে এক বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজের মঞ্চ। সেখানে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক সক্ষম রকেট, পানির নিচে চালিত ড্রোন এবং হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সেনা প্রদর্শিত হয়। এই দ্বৈত প্রদর্শনী স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, চীন কেবল কূটনৈতিক শক্তিই নয়, সামরিক শক্তিতেও নিজেকে প্রমাণ করতে চায়।
বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে চার দেশের নেতাদের উপস্থিতি—চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং ইরান। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, এ চার দেশ একটি সম্ভাব্য “অ্যান্টি-আমেরিকান অক্ষ” বা “axis of upheaval” গঠন করছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান শির কূটনৈতিক ছত্রছায়ায় উপস্থিত থাকেন। এই চার নেতার একত্র উপস্থিতি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে প্রতীকী, যেখানে বোঝানো হচ্ছে যে চীন নতুন জোট গঠনের মাধ্যমে বৈশ্বিক নেতৃত্বে দৃঢ় অবস্থান নিতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের জন্য এটি একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হিমশিম খাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু চীনের কূটনৈতিক উপস্থিতি এবং মোদির মতো আঞ্চলিক নেতাদের উষ্ণ আচরণ পশ্চিমা কৌশলবিদদের জন্য প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্কনীতি, যা ভারতসহ অংশীদার দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থাকে প্রভাবিত করছে, চীনের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।
এই সামরিক কুচকাওয়াজের সময়কালও অর্থবহ। এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। চীন ও রাশিয়া স্মরণ করাতে চায় যে, তারা ফ্যাসিবাদ পরাজিত করেছে এবং যুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক শৃঙ্খলার রক্ষক। শি ও পুতিনের বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আধিপত্যবাদী নীতি। তারা এটিকে উপস্থাপন করছেন এক “বিকল্প ইতিহাস” হিসেবে, যেখানে পশ্চিম নয়, বরং চীন-রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া-ইরান নিজেদের নিরাপত্তা উদ্বেগকে বৈধ দাবি হিসেবে তুলে ধরছে।
শি জিনপিং শুধু শক্তি প্রদর্শনেই থেমে থাকেননি। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) বৈঠকে তিনি শত শত মিলিয়ন ডলারের অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন। এটি আঞ্চলিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক নির্ভরতা চীনের দিকে ঘুরিয়ে আনার একটি কার্যকর কৌশল। তিনি আরও বলেছেন, “কয়েকটি দেশের ‘হাউস রুলস’ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।” এটি পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে সরাসরি এক আক্রমণ।
বিশ্লেষকদের মতে, শি চীনকে একটি “নিশ্চিত শক্তি” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার দেশগুলোর জন্য অস্বস্তিকর বার্তা। শি দেখাতে চাইছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে কারা গ্রহণযোগ্য হবেন, সেটি তিনি নির্ধারণ করতে পারেন, পশ্চিম নয়। এছাড়া তার এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, চীনকে বিশ্বের জন্য একটি “বিশ্বস্ত বিকল্প” হিসেবে তুলে ধরার উদ্দেশ্য বহন করছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাম্প্রতিক কূটনৈতিক অনুষ্ঠান এবং সামরিক কুচকাওয়াজ কেবল প্রতীকী প্রদর্শনী হিসেবে আয়োজন করেন নাই। এটি বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত। চীন স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, বিশ্বব্যবস্থার নিয়ম কেবল পশ্চিমা দেশগুলো তৈরি করবে না। একটি নতুন অক্ষ, নতুন জোট এবং নতুন শৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে, যার কেন্দ্রবিন্দু বেইজিং। আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই উঠে আসে ২১ শতকের আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল জিজ্ঞাসা ভবিষ্যতের বিশ্বব্যবস্থায় নেতৃত্বের আসনে বসবে কে, ওয়াশিংটন নাকি বেইজিং।