ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার সাম্প্রতিক পডকাস্টে নিজেকে একজন মানবিক এবং আদর্শের প্রতি অনুগত নেতা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, “ভুল হয়, এবং আমিও কিছু করতে পারি। আমিও মানুষ, ভগবান নই।” এই বক্তব্যে বিনয় এবং নাটকীয়তা থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রধানমন্ত্রী যখন পডকাস্টে মগ্ন তখন মণিপুর জ্বলছে। মণিপুরের মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু এবং হাজার হাজার মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। সহিংসতার তীব্রতায় নারীদের উপরও চরম নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এই সংকটকালে প্রধানমন্ত্রী মোদীর নীরবতা শুধু জনমনে হতাশা সৃষ্টি করেনি; বরং তার শাসনব্যবস্থার নৈতিক অবক্ষয়ের দিকেও ইঙ্গিত করেছে। একজন শাসক হিসেবে তিনি এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। এটি মানবীয় ত্রুটি নয়; বরং একটি পরিকল্পিত উপেক্ষা এবং নৈতিক অপরাধ।
কাশ্মিরের ক্ষেত্রে মোদী সরকারের ভূমিকা আরও উদ্বেগজনক। ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন হরণ করা হয়, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি, গণগ্রেফতার, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ কাশ্মিরের জনগণকে এক অন্ধকার অধ্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। এ ধরনের পদক্ষেপ ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ভারতে কৃষকদের অবস্থা মোদীর শাসনের আরেকটি বড় ব্যর্থতার উদাহরণ। কৃষি আইন নিয়ে বিতর্ক এবং পরবর্তীতে তা প্রত্যাহারের ঘটনা সরকারের নীতিগত অনড়তা এবং কৃষকদের প্রতি উদাসীনতার প্রতিফলন। এই আইনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহু কৃষক জীবন হারিয়েছেন। তাদের আত্মহত্যার হারও ক্রমাগত বাড়ছে। নীতিগত ব্যর্থতার এই চিত্র মোদীর কথিত মানবিক শাসনকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করে দেয়। কৃষকদের জন্য যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা শুধু অপূর্ণই রয়ে গেছে নয়, বরং এই সম্প্রদায়ের জন্য নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে।
নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ছিল মোদীর শাসনের আরেকটি ভয়াবহ ভুল, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কোটি কোটি মানুষ তাদের সঞ্চয় হারিয়েছেন, অসংখ্য ব্যবসা ধ্বংস হয়েছে, এবং কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত একটি নীতি-ব্যর্থতার চূড়ান্ত উদাহরণ, যা ভারতীয় জনগণের জীবনযাত্রার ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এটি একটি সাধারণ ভুল ছিল না; বরং সরকারের অসংগঠিত এবং আত্মকেন্দ্রিক নীতির প্রতিফলন।
মোদীর শাসনকালে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত মুসলিম এবং খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী, তার শাসনের সময়কালে ক্রমাগত নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ওপরও বৈষম্য এবং অত্যাচারের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে।
একই সঙ্গে সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তরকরণ বন্ধের নামে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো আরও স্পষ্ট করে তোলে যে, মোদীর আদর্শ এবং বাস্তবিক শাসনের মধ্যে বিশাল ফারাক রয়েছে। তিনি তার শাসনকে আদর্শের শাসন বলে দাবি করলেও, বাস্তবে এটি একটি পরিকল্পিত মতাদর্শিক আগ্রাসন।
মোদীর শাসনে যুবসমাজের জন্য যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবে রূপ পায়নি। কর্মসংস্থানের অভাব, শিক্ষার মানহীনতা আর সামাজিক স্থিতিশীলতার অভাব তরুণ প্রজন্মকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার পডকাস্টে তরুণদের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন এবং কৌশলগত প্রতারণা বলেই প্রতীয়মান হয়।
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি মোদীর শাসনের অন্যতম গুরুতর ব্যর্থতা। বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তিনি শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন করেছেন। হাসিনা সরকারের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের কর্মকাণ্ডগুলো তার নীরব মদতে আরও উৎসাহিত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পর তাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত শুধু নিজের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে দুর্বল করেছে তা-ই নয়, প্রতিবেশী দেশের মানুষের মধ্যেও আস্থার সংকট তৈরি করেছে।
এ সংকট শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়েছে। একসময় সমালোচনা করা আফগানিস্তানের কাছেই ভারতকে আবার বন্ধুত্বের জন্য হাত বাড়াতে হচ্ছে। এমন হঠকারী কৌশল ভারতের প্রতিবেশীদের মধ্যে আস্থা হারানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের নৈতিক অবস্থানকেও দূর্বল করেছে।
“আমি মানুষ, ভগবান নই” এই বক্তব্য মোদীর শাসনের ব্যর্থতা এবং অসঙ্গতিকে ধামাচাপা দেওয়ার একটি সুকৌশলী প্রচেষ্টা। প্রকৃতপক্ষে পরিকল্পিত অপকর্ম, ব্যর্থতা ও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণ। ভুল স্বীকার করা এক কথা, কিন্তু সেই ভুলের জন্য দায়বদ্ধতা গ্রহণ এবং তার প্রতিকার করাই একজন শাসকের অন্যতম দায়িত্ব। মোদীর শাসন ব্যবস্থা মূলত প্রোপাগাণ্ডা এবং প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে চলেছে, কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। আজ ভারতের সচেতন জনগণ সুশাসনের দাবি জানায়, যেখানে কথার চেয়ে কাজের মূল্য অনেক বেশি।