- বিশ্বব্যাপী জ্বালানি রূপান্তর সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
- যুক্তরাষ্ট্র-ইইউর বাণিজ্য নীতি নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
- পরিচ্ছন্ন জ্বালানি প্রযুক্তির অগ্রগতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছে।
- চীন বৈশ্বিক জ্বালানি রূপান্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ রাখে।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া টেকসই জ্বালানি ভবিষ্যৎ সম্ভব নয়।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি রূপান্তর বর্তমানে এক সংকটপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। এই রূপান্তর ব্যর্থ হলে, তার ফলাফল সবার জন্যই ভয়াবহ হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানির প্রসার ঘটানো নিয়ে বিশ্বব্যাপী ঐক্যমতে পৌঁছানো গেছে।
তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো বড় অর্থনীতিগুলো ধীরে ধীরে বাণিজ্য বাধা বাড়িয়েছে, যা গ্লোবাল ট্রেড স্যাংশন, অ্যান্টি-ডাম্পিং, শুল্ক বৃদ্ধি এবং কার্বন ট্যারিফের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উন্নয়নের ক্ষেত্রে একতরফাবাদ ও সুরক্ষাবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে।
এসব নীতিগুলো বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাণিজ্যের কাঠামো পরিবর্তন করে ফেলেছে এবং কম-কার্বন নিঃসরণ ও রূপান্তরে গভীর প্রভাব ফেলছে।
জ্বালানি রূপান্তরে পশ্চিমা বাধা
ভূরাজনৈতিক কারণগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য বিচ্ছিন্নতা (ডিকাপলিং) ঘটানোর চেষ্টা করছে, যা বিশেষভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি শিল্পে প্রতিফলিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের মে মাসে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চারটি দেশের সোলার প্যানেল রফতানির বিরুদ্ধে অ্যান্টি-ডাম্পিং এবং শুল্ক তদন্ত শুরু করে। এই পদক্ষেপ শুধু উক্ত দেশগুলোর নবায়নযোগ্য জ্বালানি শিল্পকে দমন করার চেষ্টা নয়, বরং এটি মুক্ত বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তি সরবরাহ শৃঙ্খলকে বিপর্যস্ত করেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইইউ তাদের কার্বন সীমান্ত সমন্বয় ব্যবস্থা (Carbon Border Adjustment Mechanism) চালু করেছে, যা কার্যত একধরনের কার্বন ট্যারিফ। এর ফলে উচ্চ-কার্বন শিল্পগুলোর নির্গমন হ্রাসের দায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং জ্বালানি রূপান্তরের ন্যায্যতাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন পুনরায় ক্ষমতায় এসে নতুন করে শুল্ক আরোপ এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী পরিচ্ছন্ন জ্বালানি রূপান্তরের গতিকে মন্থর করে দিয়েছে। একদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়ে উৎপাদনকে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে, তারা আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করছে, যা পরিচ্ছন্ন জ্বালানির বাণিজ্য পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বাণিজ্য সুরক্ষাবাদ যেভাবে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করছে
প্রথমত, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি প্রযুক্তির অগ্রগতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও খরচ হ্রাস পরিচ্ছন্ন জ্বালানি রূপান্তরের মূল চালিকা শক্তি। তবে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বাণিজ্য বাধা সৃষ্টি করে, তখন কম খরচে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি প্রযুক্তির প্রসার বাধাগ্রস্ত হয়। এতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে যায় এবং বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তির অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত, নতুন জ্বালানি শিল্পের ভাঙন ও বিভাজন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন, ইইউর ব্যাটারি নিয়ন্ত্রণ (Batteries Regulation), অ্যান্টি-ডাম্পিং তদন্ত ও কার্বন ট্যারিফের মতো উদ্যোগ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি শিল্পকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং নতুন জ্বালানি শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগুলো কম-কার্বন রূপান্তরের বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তারা একদিকে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করছে, অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করছে, যা নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে।
চীনের নেতৃত্বে জ্বালানি রূপান্তর কীভাবে সম্ভব?
প্রথমত, পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। চীনকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে গবেষণা ও অবকাঠামো বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারকে এমন নীতিগত সহায়তা দিতে হবে যাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কম-কার্বন প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন ঘটাতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী এই প্রযুক্তির প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়।
দ্বিতীয়ত, চীন তার নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ শৃঙ্খলের সুবিধা কাজে লাগাতে পারে। যখন বাণিজ্য সুরক্ষাবাদের কারণে বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তি শিল্পে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন চীন তার শিল্প সরবরাহ শৃঙ্খলকে আরো শক্তিশালী করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। চীনের শিল্প-শৃঙ্খলের কার্যকারিতা বজায় রেখে উৎপাদন খরচ কমানোর মাধ্যমে জ্বালানি রূপান্তরে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব।
তৃতীয়ত, বৈচিত্র্যময় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নীতির অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় চীনের উচিত নতুন বাজার অনুসন্ধান করা। বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সবুজ জ্বালানিতে সহযোগিতা জোরদার করতে পারে।
চীন যদি জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের কাঠামো কনভেনশন, জি২০, এবং ব্রিকস (BRICS)-এর মতো বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়, তবে তারা তাদের সবুজ জ্বালানির অভিজ্ঞতা ভাগ করে বিশ্বব্যাপী পরিচ্ছন্ন জ্বালানি রূপান্তরের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলতে পারবে।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি রূপান্তরকে সুরক্ষাবাদ ও ভূরাজনীতির স্বার্থপর খেলায় আটকে রাখা উচিত নয়। চীনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয়ভাবে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি রূপান্তরের পথে এগিয়ে আসতে হবে এবং বিশ্বব্যাপী টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থার জন্য কাজ করতে হবে।
চায়না ডেলিতে প্রকাশিত লিন বোচিয়াং-এর প্রবন্ধটি Informer 365 বাংলা-এর পাঠকদের জন্য সহজ ভাষায় উপস্থাপন করা হলো। উল্লেখ্য, লেখক লিন বোচিয়াং চীনের শিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্কুলের চেয়ার অধ্যাপক এবং চায়না ইনস্টিটিউট ফর স্টাডিজ ইন এনার্জি পলিসির পরিচালক।