- সিরিয়ার বিদ্রোহীরা, হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতৃত্বে এক নাটকীয় অভিযানে স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পতন ঘটায়।
- আসাদ, ২০০০ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নির্মম ও দমনমূলক শাসনের মাধ্যমে টিকে ছিলেন। তাকে পক্ষে ছিল রাশিয়া ও ইরান।
- বিদ্রোহীদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দামেস্ককে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আলেপ্পো, হামা এবং হোমসের মতো শহরগুলো দ্রুত বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়।
- এই পতন আঞ্চলিক রাজনীতির ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। ইরান এবং হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়েছে। অন্যদিকে তুরস্ক ও ইসরায়েলের মতো দেশগুলো নতুন সুযোগের সন্ধানে রয়েছে।
- এইচটিএসের অতীত এবং তাদের ইসলামী শাসন ব্যবস্থা নিয়ে গভীর সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ফলে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ আবারও সংকটের মুখে।
সিরিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটে গেছে। বিদ্রোহীদের সাহসী এবং সুসংগঠিত আক্রমণের ফলে বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের শাসনের পতন ঘটেছে। বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিল হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। এইচটিএস একসময় চরমপন্থী ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল। এই অভিযান সিরিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
আসাদের শাসনকাল : ক্ষমতার উত্থানপতন
২০০০ সালে, বাবা হাফেজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর বাশার আল-আসাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা শুরুতে তাকে সংস্কারবাদী নেতা হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু খুব দ্রুতই এই ধারণা মিথ্যে প্রমাণিত হয়। তিনি তার বাবার দমনমূলক শাসনের নীতি অবলম্বন করেন।
২০১১ সালে, আরব বসন্তের সময় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের উপর নির্মম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তার শাসনের আসল রূপ প্রকাশ পায়। তার নিষ্ঠুরতা পুরো সিরিয়াকে গৃহযুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়। এই যুদ্ধ দেশের অর্থনীতি এবং অবকাঠামো ধ্বংস করে। ৫ লক্ষের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। গৃহযুদ্ধ চলাকালে আসাদ সরকার যুদ্ধাপরাধ করেছে এবং রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে।
এইচটিএসের অভিযান শুরু হয়েছিল ইদলিব থেকে। তাদের নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জোলানি এই অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জোলানির কৌশল ছিল সিরিয়ার দুর্বল সেনাবাহিনী এবং শাসন ব্যবস্থার ফাটলগুলো কাজে লাগানো।
বিদ্রোহীরা প্রথমেই আলেপ্পো দখল করে। এটি ছিল সিরিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এরপর হামা এবং হোমসের মতো শহরগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এই অভিযান ছিল সুসংগঠিত এবং পরিকল্পিত। বিদ্রোহীরা দ্রুত দামেস্কের চারপাশ ঘিরে ফেলে। কয়েক দিনের মধ্যেই শহরটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
চূড়ান্ত বিজয়
আসাদের শাসন টিকে ছিল মূলত রাশিয়া এবং ইরানের সহায়তায়। রাশিয়া বিমান হামলার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সাহায্য করত। অন্যদিকে ইরান সরাসরি সৈন্য পাঠিয়েছে এবং হিজবোল্লাহর মতো সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে।
কিন্তু এবার তাদের সহযোগিতা ছিল সীমিত। রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার। ইরান অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি হিজবোল্লাহ, যারা একসময় আসাদের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিল, এখন নিজের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
২০২৪ সালের ৮ডিসেম্বর আল-আসাদের পতন ঘটে। একই দিনে বিদ্রোহী যোদ্ধারা ঘোষণা করেন যে তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন। বর্তমানে বাশার আল-আসাদ এবং তার পরিবার রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। রুশ বার্তা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, তাদের মানবিক কারণে রাশিয়া আশ্রয় দিয়েছে। রাশিয়ার উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বলেছেন, বাশারের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে না।
এইচটিএস এখন সিরিয়ার ভবিষ্যৎ শাসনের মুখ্য ক্রীড়ানক। প্রধান নেতা জোলানি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা সিরিয়ার স্বাধীনতার জন্য লড়েছি। এই দেশ এখন সবার।”
তবে, তাদের অতীত ইতিহাস একে সহজভাবে নিতে দিচ্ছে না। কারণ একসময় তারা আল-কায়েদার সাথে যুক্ত ছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং চরমপন্থী শাসন ব্যবস্থার জন্য তাদের সমালোচনা করা হয়।
ইরান দুর্বল, তুরস্ক ও ইসরায়েলের সম্ভাবনা
আসাদের পতনের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে ইরান এবং এর মিত্রদের ওপর। সিরিয়া ছিল ইরানের জন্য একটি কৌশলগত করিডর। এখান থেকে ইরান হিজবোল্লাহ এবং অন্যান্য গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ করত।
ইসরায়েল এই পরিবর্তনকে তাদের জন্য বিজয় হিসেবে দেখছে। ইরানের শক্তি দুর্বল হওয়ায় তারা এখন আরও নিরাপদ মনে করছে।
তুরস্কও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইতিমধ্যে বলেছেন, সিরিয়ার শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো তার অগ্রাধিকারের বিষয়। তবে তুরস্ক এইচটিএসের ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে সতর্ক।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ উভয়ই আসাদের পতনকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে এইচটিএসের অতীত এবং ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থার প্রতি তাদের উদ্বেগ রয়ে গেছে।
জাতিসংঘ মুখপাত্র বলেছেন, “এই পরিবর্তন সিরিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। তবে এটিকে শান্তি এবং স্থিতিশীলতার পথে নিয়ে যেতে হবে।”
ইসরায়েল: প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু স্বাগত জানিয়ে বলেছেন আসাদ সরকারের পতন হল ”ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রতি আঘাতের প্রত্যক্ষ ফলাফল”।
সিরিয়ার মানুষের প্রত্যাশা
সিরিয়ার মানুষ দীর্ঘ ৫ দশকের দমনমূলক শাসন থেক মুক্তি পেয়েছে। এটি তাদের জন্য একটি নতুন শুরু। তবে এই যাত্রা সহজ হবে না। দলীয় সংঘর্ষ এবং নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।এইচটিএসের অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার প্রতিশ্রুতিগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কারণ সিরিয়ানরা শুধুমাত্র দমন থেকে মুক্তি নয়, মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং তাদের জীবন পুনর্গঠনের সুযোগ চায়। নতুন বছর নির্ধারণ করবে এই মোড় পরিবর্তনটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিয়ে আসবে নাকি আবার অস্থিরতায় ডুবে যাবে সিরিয়া।