- ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কেয়ার স্টারমারকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতাদের একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
- বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য হলো নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করা।
- ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা ইউরোপীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে।
- ইইউ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের লক্ষ্যে লেবার পার্টির সরকার “ইইউ-যুক্তরাজ্য সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন” বিষয়ে গুরুত্বারোপ করছে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কেয়ার স্টারমারের অংশগ্রহণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যা ইইউ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের সম্ভাবনা সূচিত করছে।
উল্লেখ্য যে ব্রেক্সিটের পরে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অনেকটা সংকুচিত হয়ে পড়েছিল, তবে এই ধরনের সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের উপস্থিতি তার ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি শুধু রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নতিরই চিত্র নয়, বরং উভয় পক্ষের মধ্যে বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সহযোগিতার এক নতুন সুযোগের সৃষ্টি করেছে।
এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে চলমান যুদ্ধ, যেমন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং সেই সঙ্গে ইরান, চীন, ও উত্তর কোরিয়ার সহযোগিতা বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য এক গুরুতর হুমকি তৈরি করেছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন এবং তার ন্যাটো থেকে সরে যাওয়ার হুমকি ইউরোপের নিরাপত্তাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সংকটপূর্ণ লবশ্বিক পরিস্থিতিতে ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে একত্রে কাজ করার গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক পুনর্গঠন
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে লেবার সরকার তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন কাটিয়ে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করতে সরকার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামির ইইউ পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এই বৈঠকে ইউরোপীয় কৌশলগত সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী র্যাচেল রিভস ইইউ অর্থমন্ত্রীর সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। তিনি ব্রেক্সিট-পরবর্তী আর্থিক সহযোগিতার সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন।
এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী স্যার কেয়ার স্টারমার ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেছেন। এই বৈঠক উভয় পক্ষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
এই উদ্যোগগুলোর লক্ষ্য হলো ইইউ-যুক্তরাজ্য সম্পর্কের নতুন মাইলফলক নির্ধারণ করা। কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং কৌশলগত প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে, ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন এবং অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা চলছে।
লেবার সরকারের আন্তরিকতার সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা শুধু বর্তমান চ্যালেঞ্জ নয় বরং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পথকেও সুগম করবে।
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা এক নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে, যা ব্রেক্সিট-পরবর্তী সম্পর্কের পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি, বিশেষত রাশিয়ার আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড এবং সাইবার হুমকির প্রেক্ষাপটে, এই সহযোগিতাকে “low-hanging fruit” হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা, সাইবার হামলার প্রতিরোধ, এবং উত্তর সাগরের গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি অবকাঠামোর সুরক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই উভয় পক্ষের মধ্যে কার্যকর আলোচনা ও অংশীদারিত্ব শুরু হয়েছে।
এই প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ছাড়াই উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক হতে পারে, কারণ এটি উভয় পক্ষেরই কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করে। ন্যাটোর ছায়াতলে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা আরও গভীর হয়েছে, যা ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। এই সহযোগিতা ব্রেক্সিট-পরবর্তী সম্পর্ককে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে এবং উভয় পক্ষের আস্থা পুনর্গঠনে সহায়ক হতে পারে।
বাণিজ্য ও অর্থনীতি: জটিল চ্যালেঞ্জ
ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের পুনর্গঠন অত্যন্ত জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। অফিস ফর বাজেট রেসপনসিবিলিটির তথ্য অনুযায়ী, ব্রেক্সিটের ফলে যুক্তরাজ্যের মোট জিডিপি দীর্ঘমেয়াদে ৪% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য লেবার সরকার বাণিজ্য বাধা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে ইইউর কঠোর শর্ত এবং পোস্ট-ব্রেক্সিট সীমাবদ্ধতা মোকাবিলা করা ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না। যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যেই কাস্টমস ইউনিয়ন বা সিঙ্গেল মার্কেটে পুনঃপ্রবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ইইউর সঙ্গে বড় অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি অন্তরায়।
ইইউর পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যার মধ্যে যুক্তরাজ্যের জলসীমায় দীর্ঘমেয়াদী মাছ ধরার অধিকার অন্যতম। পাশাপাশি, ইইউ একটি “ইয়ুথ মোবিলিটি স্কিম” চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে, যা ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের জন্য উভয় অঞ্চলে কাজ এবং পড়াশোনার সুযোগ প্রদান করবে।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য শিল্প ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের জন্য পেশাগত যোগ্যতার স্বীকৃতি এবং কৃষি পণ্যের বাণিজ্যে বাধা কমানোর জন্য ভেটেরিনারি চুক্তি করতে আগ্রহী। উভয় পক্ষের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হলে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সমঝোতা করতে হবে, যা কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে।
পরিবেশ ও জ্বালানি সহযোগিতা
উত্তর সাগরে পরিবেশ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। এই অঞ্চলে পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদন এবং সাশ্রয়ী জ্বালানি সরবরাহের সুযোগ উভয় পক্ষেরই অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত স্বার্থ রক্ষা করে।
বারিংগা কনসালটেন্সির একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই খাতে যৌথ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ২০৪০ সালের মধ্যে ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের ভোক্তারা প্রায় €৪৪ বিলিয়ন পর্যন্ত সঞ্চয় করতে সক্ষম হবেন। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জ্বালানি অবকাঠামোর উন্নয়নের মাধ্যমে দুই পক্ষই কার্বন নির্গমন হ্রাসের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবদান রাখতে পারে।
এই সহযোগিতা কার্যকর করতে হলে কৌশলগত পরিকল্পনা এবং অভিন্ন নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন হবে। উত্তর সাগরের সমুদ্রবায়ু প্রকল্প এবং সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদন উদ্যোগের মতো উদ্যোগগুলোতে যৌথ বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই শক্তি উৎপাদনে সহায়ক হতে পারে। একইসঙ্গে, পরিবেশগত প্রকল্পগুলোর জন্য প্রযুক্তি বিনিময় এবং গবেষণায় পারস্পরিক অংশীদারিত্ব দুই অঞ্চলের জন্যই পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ করবে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া একদিকে যেমন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি বড় ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও বয়ে এনেছে। ব্রেক্সিটের ফলে বাণিজ্য, অভিবাসন, এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিভাজন উভয় পক্ষের জন্যই দীর্ঘমেয়াদে জটিলতা তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই ব্রেক্সিট-জনিত ধাক্কায় সংকুচিত হয়েছে, এবং অফিস ফর বাজেট রেসপনসিবিলিটি (OBR) পূর্বাভাস দিয়েছে যে যুক্তরাজ্যের জিডিপি প্রায় ৪% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। পাশাপাশি, ইইউও তাদের অভ্যন্তরীণ বাজার এবং কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করতে কঠোর অবস্থান অবলম্বন করেছে।
এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, উভয় অঞ্চলের জনগণের মধ্যে সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষা ক্রমবর্ধমান। সাম্প্রতিক জনমত জরিপ ইঙ্গিত দেয় যে পূর্বের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের চেয়ে এখন অধিকাংশ মানুষ আরও কার্যকর ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে। এটি এক নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে বাণিজ্য, গবেষণা, শিক্ষা, এবং পরিবেশগত প্রকল্পের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলা সম্ভব।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এই সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করা গেলে, তা দীর্ঘমেয়াদে উভয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।