- ২০২৪ সালে মণিপুরে মৈতেই এবং কুকি-জো গোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত সংঘাত তীব্র হয়।
- মৈতেই সম্প্রদায়ের তফসিলি উপজাতি মর্যাদা দাবি সংঘাতের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সহিংসতা, বোমা হামলা, এবং রকেট হামলার মাধ্যমে পরিস্থিতি জটিল হয়।
- বছরের শেষে ২৫০ জনেরও বেশি প্রাণহানি এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, শান্তির আশা ক্ষীণ।
মণিপুরে এই সংঘাতের শিকড় বহু পুরনো। রাজ্যের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যাগুলো জড়িত। ২০২৪ সালের সংঘাতের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল মৈতেই সম্প্রদায়ের তফসিলি উপজাতি (Scheduled Tribe) মর্যাদা দাবি। এই মর্যাদা পেলে সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় সংরক্ষণের সুবিধা লাভ করা যেত। তবে কুকি-জো গোষ্ঠী, যারা ইতিমধ্যেই এই মর্যাদার অধিকারী, তারা মনে করেছিল এটি তাদের জন্য আর্থ-সামাজিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করবে।
কুকি-জো সম্প্রদায় আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, মৈতেই সম্প্রদায় এই মর্যাদা পেলে তাদের জমি ও সম্পত্তির অধিকার হুমকির মুখে পড়বে। এই দাবির বিরোধিতা থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা সহিংস সংঘাতে রূপ নেয়।
২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে নতুন করে সহিংসতার সূচনা ঘটে। ১ জানুয়ারি থৌবাল জেলায় নিষিদ্ধ পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA) সদস্যদের হামলায় চারজন গ্রামবাসী নিহত হন। এই ঘটনায় রাজ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকার উপত্যকার পাঁচটি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে ইম্ফল পূর্ব জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মইরাংথেম অমিত সিং-এর বাড়িতে হামলা হয়। এই ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বাড়তে থাকে, যা রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে পুরোপুরি ভেঙে দেয়।
লোকসভা নির্বাচন ও সংঘাতের বিস্তার
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন সংঘাতকে আরও গভীর করে তোলে। এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম দফার নির্বাচনে ইভিএম (EVM) ধ্বংস, ভোটারদের উপর গুলি চালানো এবং ভয় দেখানোর মতো ঘটনাগুলো সংঘাতকে তীব্র করে। নির্বাচন চলাকালীন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়।
যদিও দ্বিতীয় দফার নির্বাচন অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়, তবে প্রথম দফার সহিংসতা রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। নির্বাচনী সহিংসতা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করে তোলে।
সহিংসতা: জুন থেকে নভেম্বর
জুন মাসে জিরিবাম জেলায় একটি মৃতদেহ পাওয়া যায়। এই ঘটনার পর সংঘাত নতুন মাত্রা পায়। গুলি বিনিময়, অগ্নিসংযোগ এবং বাড়িঘর ধ্বংসের ঘটনা ঘটে। এক মাসের মধ্যেই ১,০০০-এরও বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের সংঘাতে ড্রোন ব্যবহার করা হয়। ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ইম্ফল পশ্চিম জেলার কাউট্রুক গ্রামে সন্দেহভাজন কুকি যুবকেরা ড্রোন থেকে বোমা ফেলে। এই হামলায় একজন নারী নিহত এবং নয়জন আহত হন। কয়েকদিন পর বিষ্ণুপুর জেলায় একটি রকেট হামলায় একজন বৃদ্ধ নিহত হন।
নভেম্বর মাসে জিরিবামের একটি পুলিশ স্টেশনে কুকি-জো গোষ্ঠীর হামলা সংঘাতকে আরও উসকে দেয়। এই হামলায় ১০ জন কুকি যুবক নিহত হন। এর পরের দিন দুটি মৈতেই বৃদ্ধের পোড়া দেহ পাওয়া যায়।
বছর শেষে বিধ্বস্ত মণিপুর
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ মণিপুর এক বিধ্বস্ত রাজ্যে পরিণত হয়। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতায় ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। কেন্দ্রীয় সরকার শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
স্থানীয় নেতারা স্বায়ত্তশাসন এবং কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। কেউ মৈতেই সম্প্রদায়ের জন্য অতিরিক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবি করছেন, আবার কেউ কুকি-জো গোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
২০২৪ সাল মণিপুরের জন্য এক অন্ধকার অধ্যায়। সংঘাতের কারণে পরিবারগুলো ভেঙে গেছে। সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। স্থায়ী শান্তির আশা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে।
সরকার এবং মণিপুরের জনগণের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিদ্যমান বিভাজন দূর করে সংঘাতের মূল কারণগুলোর সমাধানে অগ্রসর হওয়া। শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ দীর্ঘ এবং কঠিন। তবু এটি গ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। মণিপুরের জনগণের জন্য স্থায়ী সমাধান এবং পুনর্গঠনই একমাত্র উপায়।