• ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুনঃনির্বাচন ভারতের জন্য নতুন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
  • ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি ভারতীয় রপ্তানি এবং বাণিজ্য খাতে নেতিবাচক  প্রভাব ফেলতে পারে।
  • কঠোর H-1B ভিসা নীতি ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাত এবং প্রবাসী ভারতীয়দের আয়কে প্রভাবিত করবে।
  • চীনবিরোধী নীতির কারণে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক শক্তিশালী হলেও অতিরিক্ত চাপ চীন-ভারত কূটনীতিকে জটিল করতে পারে।
  • রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে ভারতের অংশীদারিত্ব নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে পড়তে পারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুনরায় বিজয় ভারতের জন্য একটি জটিল কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক দৃঢ় হলেও, ট্রাম্পের পূর্ববর্তী প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা বলে দেয় যে, তার নীতি ভারতের স্বার্থের সঙ্গে সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষ করে বাণিজ্য, অভিবাসন, এবং আন্তর্জাতিক কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে, ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় আসা ভারতের জন্য একাধিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

বাণিজ্যিক জটিলতার পুনরাবৃত্তি

ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ক বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে একটি শক্তিশালী সংযোগের প্রতীক। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় $১১৫ বিলিয়ন। তবে, ট্রাম্পের আগের প্রশাসনের সময় “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির কারণে ভারতীয় অর্থনীতি একাধিক চাপে পড়েছিল। কারণ ভারত আমদানির তুলনায় রপ্তানি বেশি করে।

ট্রাম্প ২০১৯ সালে ভারতের জিএসপি (Generalized System of Preferences) সুবিধা বাতিল করেন, যা ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। এবারও তার শুল্ক নীতি ভারতের পণ্যের জন্য মার্কিন বাজারে প্রবেশ কঠিন করতে পারে।

ট্রাম্পের নীতিগুলো প্রাথমিকভাবে মার্কিন শিল্পের স্বার্থে কেন্দ্রীভূত। তিনি আমদানি পণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে মার্কিন অর্থনীতিকে অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী করতে চান। ভারতীয় ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর অতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর কারণে ট্রাম্পের আগের প্রশাসনের সময় এই খাতগুলোতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছিল। ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় আসা এই ধরনের সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে।

ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি

ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির কারণে আগেও ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাত সংকটের মুখে পড়েছিল। H-1B ভিসার কঠোর নিয়ম এবং সীমাবদ্ধতার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পেশাদারদের কর্মসংস্থান কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতীয় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো, যেমন ইনফোসিস, উইপ্রো এবং টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস, এই নীতির ফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়।

ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাত মার্কিন বাজারের ওপর  নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা ভারতীয় প্রযুক্তি কর্মীদের আয় ভারতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় আসা এই খাতের জন্য আরও কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। অভিবাসন নীতির পরিবর্তন শুধুমাত্র পেশাদার কর্মীদের নয়, প্রবাসী ভারতীয়দের রেমিট্যান্স আয়েও প্রভাব ফেলবে, যা ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

প্রসঙ্গ চীন, ত্রিমুখী চাপ

ট্রাম্প প্রশাসনের চীনবিরোধী নীতি ভারতের জন্য সুবিধা এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই তৈরি করতে পারে। একদিকে, চীনকে মোকাবিলা করার জন্য ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার হতে পারে। অন্যদিকে, চীনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত কঠোর অবস্থান নেওয়ার জন্য ভারতকে চাপ দেওয়া হতে পারে, যা সীমান্ত সংঘর্ষ এবং কূটনৈতিক টানাপোড়েন বাড়াতে পারে।

ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা বজায় রাখা, পাশাপাশি চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য ধরে রাখা। চীন-ভারত সম্পর্ক ইতিমধ্যেই সীমান্ত বিরোধ এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে জটিল। ট্রাম্পের পুনরায় নির্বাচিত হওয়া এই সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

রাশিয়া বিষয়ক জটিলতা

ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বহু পুরোনো। ভারতের S-400 প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি ট্রাম্পের আগের মেয়াদে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে ওঠে। ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেয়, যদিও তা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।

ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় আসা এই ইস্যুকে নতুন করে উত্থাপন করতে পারে। ভারত যদি রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি খাতে সম্পর্ক বজায় রাখে, তবে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এটি ভারতের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বে একটি বড় সংকট তৈরি করতে পারে।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং কৌশল

ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ভারতের অর্থনীতিকে বহুমুখী চাপের মুখে ফেলতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি এবং ওষুধ খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মোদি সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অভ্যন্তরীণ চাপ মোকাবিলা করা এবং আন্তর্জাতিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব বজায় রাখা।

মোদি সরকারকে বাণিজ্যের বিকল্প বাজার তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার বাজারে প্রবেশ বাড়ানো প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তি এবং উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করার জন্য সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরায় নির্বাচিত হওয়া ভারত-মার্কিন সম্পর্কের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি ভারতের জন্য একদিকে যেমন সুযোগ তৈরি করেছে, অন্যদিকে তেমন চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে।

মোদি সরকারের জন্য এটি একটি পরীক্ষার মুহূর্ত। কৌশলগত দক্ষতা, অর্থনৈতিক সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে ভারত কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, তা সময়ই বলে দেবে। এই সংকট যদি সঠিকভাবে সামাল দেওয়া যায়, তবে তা ভারতের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।

Share.
সম্পাদক ও প্রকাশক: INFORMER365TEAM | Email: info@informer365.com
© 2025 Informer 365 বাংলা | Powered by Friday Pixels.
Exit mobile version