ডোনাল্ড ট্রাম্প তার রাজনৈতিক জীবনে বরাবরই বিতর্কিত মন্তব্য ও সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত। এবার তার সাম্রাজ্যবাদী ধারণা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি তিনটি বড় পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন। এগুলো হলো কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ড কেনা এবং পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার। এই প্রস্তাবগুলো সমর্থন এবং সমালোচনার ঝড় তুলেছে।
কানাডা: ৫১তম অঙ্গরাজ্যের প্রস্তাব
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল-এ একটি পোস্ট করেন। তিনি লিখেন, “অনেক কানাডিয়ান চান কানাডা ৫১তম অঙ্গরাজ্য হয়ে যাক। এতে তারা কর ও সামরিক ব্যয়ে বিশাল সঞ্চয় করতে পারবে। এটি একটি চমৎকার ধারণা।”
তবে কানাডার জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতারা তার এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ৬ থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত লেজারের এক জরিপে এই মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ১৩ শতাংশ কানাডিয়ান এই ধারণাকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে, ৮২ শতাংশ কানাডিয়ান এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন।
এই ঘোষণার পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দ্রুত ফ্লোরিডার মার-এ-লাগো রিসোর্টে যান। তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেন। তবে বৈঠকের পর ট্রাম্প তাকে ব্যঙ্গ করে “গভর্নর ট্রুডো” নামে অভিহিত করেন। এই মন্তব্য ট্রুডোর প্রতি ট্রাম্পের মনোভাব স্পষ্ট করে।
গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রচেষ্টা
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদ থেকেই গ্রিনল্যান্ড কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছেন। ২২ ডিসেম্বর তিনি ট্রুথ সোশ্যাল-এ একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লেখেন, “গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
গ্রিনল্যান্ড একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এটি ডেনমার্কের অধীন। অঞ্চলটি আকারে বিশাল—৮৩৫,০০০ বর্গমাইল। কিন্তু এর জনসংখ্যা মাত্র ৬০,০০০।
গ্রিনল্যান্ড কেনার এই প্রচেষ্টা নতুন নয়। ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ডেনমার্ককে ১০০ মিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ দিয়ে এটি কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ডেনমার্ক এই প্রস্তাবে আগ্রহী হয়নি।
২০১৯ সালে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডরিকসেন ট্রাম্পের প্রস্তাবকে “অযৌক্তিক” বলে অভিহিত করেন। এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প তার ডেনমার্ক সফর বাতিল করেন।
পানামা খাল পুনরুদ্ধারের দাবি
ট্রাম্পের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার আরেকটি অংশ হলো পানামা খালের ওপর পুনরায় মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ২১ ডিসেম্বর তিনি বলেন, “পানামা যে ফি নিচ্ছে তা হাস্যকর। যুক্তরাষ্ট্রের উদারতার বিপরীতে এই ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।”
পানামা খাল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে তৈরি হয়েছিল। এটি ১৯৯৯ সালে পানামার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই চুক্তি ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার স্বাক্ষর করেছিলেন।
ট্রাম্প মনে করেন, পানামা খালের বর্তমান নীতি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি দাবি করেছেন, যদি নীতিগত ও আইনি শর্তগুলো মেনে চলা না হয়, তবে খালটি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনা উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ শন অ্যাডামস বলেন, “ট্রাম্পের পরিকল্পনা ১৯শ শতাব্দীর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ধাঁচে তৈরি। তখন রিপাবলিকান সরকারকে বিশ্বের জন্য আমেরিকার উপহার হিসেবে বিবেচনা করা হতো।”
তিনি আরও বলেন, “এই পরিকল্পনা আধুনিক আমেরিকান কূটনৈতিক নীতির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি দ্রুত ভূখণ্ড অধিগ্রহণের ওপর জোর দেয়।”
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ড্যানিয়েল ইমারওয়ার বলেন, “ট্রাম্প পুরনো শক্তি প্রদর্শনের ধারণা ফিরিয়ে আনতে চান। এটি আধুনিক যুগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
ইমারওয়ার আরও উল্লেখ করেন, “ট্রাম্প জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান। এটি আধুনিক কূটনৈতিক ও সামরিক অংশীদারিত্বের ধারণার থেকে ভিন্ন।”
শেষ কথা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্রাজ্যবাদী নীতিগুলো আমেরিকান রাজনীতিতে নতুন আলোচনার সূচনা করেছে। তার প্রস্তাবগুলো বিতর্কিত হলেও, তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে।
তবে বাস্তবতা হলো, কানাডা বা গ্রিনল্যান্ডের মতো দেশগুলো এই প্রস্তাবে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। পানামা খাল পুনরুদ্ধারের দাবিও রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের এই উচ্চাভিলাষী নীতিগুলো আমেরিকার ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যবাদ ও আধুনিক কূটনীতির মধ্যে গভীর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে। তার প্রস্তাবগুলো এক নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।
এই ফিচার নিউজ উইক-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের আলোকে লেখা।