মঙ্গলবার | আগস্ট ১২ | ২০২৫

বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং মানবিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছে। সম্প্রতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা কেবল আইনি দিক থেকেই নয়, বরং জাতির নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, আগামী বিজয় দিবসের আগে সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন হবে, যা জাতিকে একটি অপরাধমুক্ত ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে।

গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামল ‘ফ্যাসিবাদের অধ্যায়’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড, জুলাই বিদ্রোহে হত্যাকাণ্ড এবং গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ এই অধ্যায়ের নির্মম দিক। এসব অপরাধ শুধু আইনের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেনি, বরং মানবাধিকারের সর্বজনীন নীতিমালা এবং জাতির মানবিক মূল্যবোধকে সঙ্কটাপন্ন করেছে। সুতরাং, এসব অপরাধের বিচার শুধু অপরাধীদের শাস্তি নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

তবে, ন্যায়বিচারের এই যাত্রা সহজ নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি ভেঙে পড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেছে। ড. আসিফ নজরুল নিজেই উল্লেখ করেছেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার কাঠামো গঠনের জন্য নতুন প্রসিকিউটর নিয়োগ এবং বিচার ব্যবস্থার পুনর্গঠন প্রয়োজন হয়েছে। এটি স্পষ্ট যে, একটি সুশৃঙ্খল এবং কার্যকর বিচারিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠায় সরকারকে বিরাট প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান আশ্বস্ত করেছেন যে, বিচার প্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হচ্ছে। বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে যাতে কেউ এই প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। তবে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে প্রশাসনিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সমালোচনা চলছে। উপদেষ্টা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ডিজিটাল অপরাধ মোকাবিলার জন্য আইনটি বজায় রাখা জরুরি, তবে কিছু ধারায় সংস্কার আনা হবে যাতে নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রাজনৈতিক মতপ্রকাশ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

ড. আসিফ নজরুল জনগণের ভালোবাসা এবং সমালোচনাকে সরকারের শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা সরকারের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার প্রতি মনোযোগের ইঙ্গিত দেয়। তিনি জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন, তারা সরকারের কাজের ইতিবাচক সমালোচনা করুক। সরকারের এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ন্যায়বিচারের পথ আরও মসৃণ করতে সাহায্য করবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শীর্ষ অপরাধীদের বিচারকেই ট্রাইব্যুনালের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে, প্রান্তিক মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য ট্রাইব্যুনালের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা সরকারকে ভবিষ্যতে মোকাবিলা করতে হবে।

জাতীয় সংলাপ ২০২৪-এর অধিবেশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা এবং ভুক্তভোগীরা যে প্রত্যাশা প্রকাশ করেছেন, তা স্পষ্ট করেছে যে, এই বিচারিক প্রক্রিয়া কেবল একটি প্রশাসনিক কাজ নয়, বরং জাতীয় ঐক্যের জন্য অপরিহার্য। বিচার প্রক্রিয়ার সাফল্য জাতির আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে একটি মানবিক ও ন্যায্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। এই বিচার প্রক্রিয়া যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, তবে তা শুধু অতীতের অপরাধের নিষ্পত্তি করবে না, বরং একটি নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা মানে কেবল অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া নয়; এটি জাতির সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। এই যাত্রায় সরকার কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে তাদের কর্মক্ষমতা, স্বচ্ছতা এবং জনগণের সমর্থনের ওপর।

Leave A Reply

নির্বাহী সম্পাদক : সাঈদ আহমেদ
সম্পাদক ও প্রকাশক : ফরহাদ হোসাইন
আঞ্চলিক অফিস নিকেতন হাউজিং সোসাইটি, গুলশান, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত।
যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: info@informer365.com
©2025 Informer365 বাংলা (Bengali). Designed by PaddlePress.
Exit mobile version