বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর এবং জটিল সংকটগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম। এর প্রভাব প্রতিটি স্তরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে এর সবচেয়ে গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছে কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি ব্যবস্থা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কৃষিজমি উর্বরতা হারাচ্ছে, ফলন কমছে এবং মৌসুম পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদনের সময়কাল অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা ইতিমধ্যেই অনেক দেশের অর্থনীতি এবং জনগণের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮৫০ সালের পর থেকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। তাপমাত্রার বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদনকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।

উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ এশিয়ায় অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ ধান, গম এবং অন্যান্য প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস করেছে। পাকিস্তান এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে উচ্চ তাপমাত্রা ফসলের বৃদ্ধি মন্থর করেছে এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস করেছে। অপরদিকে, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে গেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধু উৎপাদন কমছে না, কৃষি পদ্ধতিতেও নাটকীয় পরিবর্তন আসছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত এবং ঘন ঘন বন্যা কৃষিজমির ক্ষতি সাধন করছে। ২০২২ সালের বাংলাদেশে এক মাসের মধ্যে দুবার বন্যার কারণে হাওর অঞ্চলের ধান সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে, যা খাদ্য উৎপাদনের ওপর দীর্ঘমেয়াদী চাপ সৃষ্টি করছে।

কৃষিজ উৎপাদনের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের এমন প্রভাবের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এই গ্যাসগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে তুলছে, যা কৃষি উৎপাদনের জন্য অনুকূল পরিবেশকে বিপর্যস্ত করছে। উন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অদক্ষ সেচব্যবস্থা এই সংকটকে ত্বরান্বিত করেছে। আমাজন বন উজাড় এবং আফ্রিকার বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে গ্রহের প্রাকৃতিক কার্বন শোষণের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক বাজারে গম এবং চালের দাম ২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক দেশ, যারা খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তারা তীব্র খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সংকটের কারণে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে।

খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নাই। টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এই সংকট হতে মুক্ত হওয়া যেতে পারে। জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীদের আরও গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে। উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রযুক্তিগত প্রদানের ক্ষেত্রে আরও আন্তরিক হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, প্যারিস চুক্তির মতো উদ্যোগ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নির্গমন কমাতে হবে। পাশাপাশি তহবিল বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। আবার উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি খাতের এই সংকট সামাল দিতে দেরি করা মানে ভবিষ্যতের জন্য আরও গভীর সংকট তৈরি করা। বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায়, জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপর্যয় পৃথিবীকে বিপর্যস্ত করবে, মানব সভ্যতাকে এক গভীর ক্ষুধার চক্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিবে।

©teamINFORMER356

Share.
সম্পাদক ও প্রকাশক: INFORMER365TEAM | Email: info@informer365.com
© 2025 Informer 365 বাংলা | Powered by Friday Pixels.
Exit mobile version