নগরায়ণ বা শহরমুখী উন্নয়ন আজকের বিশ্বের এক অনিবার্য বাস্তবতা। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের মধ্যেই বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশের বেশি শহরে বসবাস করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে ৬৮ শতাংশে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এই দ্রুত নগরায়ণ শিল্পায়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতীক হলেও এর সঙ্গে গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জও যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই চ্যালেঞ্জ আরও জটিল আকার ধারণ করছে। নগরায়ণ একদিকে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার সুযোগ তৈরি করছে, অন্যদিকে এটি পরিবেশ, অবকাঠামো এবং সামাজিক সম্পর্কের ওপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করছে।

বিশ্বজুড়ে শহরগুলোর বৃদ্ধি মূলত কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং জীবনের মান উন্নয়নের প্রলোভনের কারণে। কৃষি নির্ভর গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, যারা দারিদ্র্যের শিকার, তারা উন্নত জীবনের আশায় শহরে পাড়ি জমায়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে গত দশকে গ্রামীণ থেকে শহরে অভিবাসনের হার প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে, বাংলাদেশেও গ্রাম থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের মতো বড় শহরে অভিবাসন দ্রুত বাড়ছে। এই অভিবাসনের কারণ গ্রামে কর্মসংস্থানের অভাব এবং শহরে শিল্প ও সেবা খাতে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি। তবে এই প্রবৃদ্ধি অনিয়ন্ত্রিত হলে শহরের অবকাঠামো এবং পরিবেশে গভীর সংকট সৃষ্টি করে।

নগরায়ণের ফলে শহরগুলোতে বাসস্থান, স্যানিটেশন এবং পরিবহন ব্যবস্থায় চাপ বাড়ছে। ঢাকা, মুম্বাই এবং নাইরোবি শহরের মতো উন্নয়নশীল অঞ্চলের বড় শহরগুলোতে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এই চ্যালেঞ্জকে আরও গভীর করেছে। ঢাকার ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ বস্তিতে বসবাস করে, যেখানে পানীয় জলের অভাব, অনুপযুক্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির ঘটনা প্রতিদিনের বাস্তবতা। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের ৭৫ শতাংশের বেশি শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বস্তিতে বাস করে। এসব বস্তি এলাকার জীবনযাত্রা এমনই শোচনীয় যে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি এবং সংক্রামক রোগের হার খুবই বেশি।

নগরায়ণের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিবেশগত অবক্ষয়। শহর সম্প্রসারণের জন্য বনাঞ্চল ধ্বংস এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরে অতিরিক্ত নগরায়ণের ফলে পানির উৎসগুলো শুকিয়ে গেছে। একইভাবে, ভারতের দিল্লি শহরে বায়ু দূষণ এতটাই তীব্র যে এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি স্থায়ী হুমকি। ২০২৩ সালে দিল্লির বায়ু দূষণের মান ডব্লিউএইচও নির্ধারিত সীমার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ছিল।

নগরায়ণ কেবল পরিবেশের উপরই নয়, সামাজিক অসমতার ওপরও প্রভাব ফেলছে। উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ শহরে আসা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায়শই অধরা থেকে যায়। উচ্চ আয়ের মানুষেরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারলেও নিম্ন আয়ের মানুষেরা সীমিত আয় এবং সেবার অভাবে কষ্ট পায়। উদাহরণস্বরূপ, নিউইয়র্ক শহরে ধনী এবং দরিদ্রের আয়ের পার্থক্য মার্কিন জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। এই বৈষম্য অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা সমাজের স্থিতিশীলতায় বিরূপ প্রভাব ফেলে।

নগরায়ণের ফলে শহরের অবকাঠামো ব্যবস্থাও চরমভাবে ভেঙে পড়ছে। পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা শহরে যানজট এবং পরিবেশ দূষণ বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকায় প্রতিদিন যানজটের কারণে অর্থনীতিতে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে বলে এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে, নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে মানসিক চাপ বাড়ছে এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।

এই সংকট মোকাবিলার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকারকে একত্রে কাজ করতে হবে। পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা, স্মার্ট সিটি উদ্যোগ এবং শক্তি দক্ষ প্রযুক্তির ব্যবহার নগরায়ণের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে সহায়ক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরের স্মার্ট সিটি মডেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, শক্তি সঞ্চয় এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চমৎকার সাফল্য দেখিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই মডেল অনুসরণ করা একটি কার্যকর পথ হতে পারে।

তবে নগরায়ণের প্রকৃত সুফল পেতে হলে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ তাদের নাগালের মধ্যে আনতে হবে। জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এই বিষয়ে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। টেকসই নগর উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং অর্থায়ন জরুরি।

নগরায়ণ আজকের বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের প্রয়োজন। তবে এটি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের পরিবেশ, সমাজ এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে। টেকসই নগর উন্নয়নের জন্য এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্তই ভবিষ্যতের জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করতে পারে।

Share.
সম্পাদক ও প্রকাশক: INFORMER365TEAM | Email: info@informer365.com
© 2025 Informer 365 বাংলা | Powered by Friday Pixels.
Exit mobile version