বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব এখন আর ভবিষ্যতের কোনো পূর্বাভাস নয়। এটি আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর হিমবাহগুলো, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে দৃশ্যমান শিকার, দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। এই সংকট শুধু পরিবেশ বা প্রকৃতির সৌন্দর্যের ওপর নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষি এবং সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তরে গভীর প্রভাব ফেলছে।

ইউরোপের অস্ট্রিয়া ও ইতালির সীমান্তে অবস্থিত হিমবাহগুলো এ সংকটের অন্যতম প্রমাণ। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি অঞ্চলগুলো পর্যটন এবং গবেষণার কেন্দ্রে থাকলেও, বর্তমানে সেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধ্বংসের মুখে। ইতালির সীমান্তবর্তী হিমবাহের জলপ্রবাহ একসময় দুই দেশে ভাগ হতো, কিন্তু এখন তা কেবল অস্ট্রিয়ার দিকে প্রবাহিত।

ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে হিমবাহের পৃষ্ঠতলের ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার বরফ গলে গেছে। শুধু ইউরোপে নয়, এই প্রক্রিয়া পৃথিবীর প্রায় সব হিমবাহ অঞ্চলে ঘটছে।

পৃথিবীর বৃহত্তম হিমবাহ ব্যবস্থা হিমালয়ে। চীন, ভারত, পাকিস্তান এবং নেপালের মতো দেশের জন্য এটি জীবনরক্ষার ভূমিকা পালন করে। হিমালয়ের গলিত জল নদীগুলোর মাধ্যমে কোটি কোটি কৃষকের চাষাবাদে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (UNEP) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১০০ সালের মধ্যে হিমালয়ের দুই-তৃতীয়াংশ হিমবাহ গলে যাবে, যদি তাপমাত্রা বর্তমান হারে বাড়তে থাকে।

ভারতের লাদাখ অঞ্চলে স্নো স্টুপা প্রকল্পের মাধ্যমে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করে এই সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। যদিও এটি কিছুটা আশার আলো দেখায়, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই সংগ্রাম যে দীর্ঘমেয়াদে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।

অস্ট্রিয়া এবং ইতালির মতো ইউরোপীয় দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের জাতীয় সীমান্ত পুনর্নির্ধারণে বাধ্য হচ্ছে। সুইজারল্যান্ড এবং ইতালির মধ্যেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। ২০০৯ সালে, দুই দেশের সরকার একটি চুক্তি করে তাদের হিমবাহ-প্রভাবিত সীমান্ত পুনঃনির্ধারণ করে।

তবে হিমবাহ সংকটের ফলে সীমান্ত পরিবর্তনের জটিলতা কেবল ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নয়। এশিয়ার কারাকোরাম রেঞ্জে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সিয়াচেন গ্লেসিয়ার নিয়ে বিরোধ নতুন মাত্রা পেয়েছে। গলিত বরফ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই এলাকা আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।

হিমবাহ গলনের প্রভাব কেবল সীমান্ত ও কৃষিকাজে নয়, পর্যটন শিল্প এবং জীববৈচিত্র্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে এবং আইসল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে হিমবাহ পর্যটন অর্থনীতির বড় অংশ। কিন্তু গলিত বরফের কারণে এই শিল্প হুমকির মুখে।

উদাহরণস্বরূপ, সুইজারল্যান্ডের আল্পস অঞ্চলে গত দুই দশকে হিমবাহ পর্যটনে ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বরফ গলে যাওয়ার ফলে পাহাড়ি অঞ্চলের স্থিতিশীলতা কমে যাওয়ায় ভূমিধস এবং অন্যান্য বিপর্যয়ের ঝুঁকি বেড়েছে।

হিমবাহ সংকোচনের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন কিছুটা আশার আলো জাগাচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানীরা একধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যা কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরি করতে পারে। যদিও এই পদ্ধতি পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর হতে পারে, এটি হিমবাহের মতো জটিল এবং প্রাকৃতিক কাঠামোর বিকল্প হতে পারবে না।

হিমবাহ শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয় নয়, এটি মানব আবেগের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানী ম্যাথিয়াস হুস বলেছেন, “যখন আপনি পাহাড়ে যান এবং দেখেন যে হিমবাহটি আর নেই, তখন তা শুধুই তথ্যগত ক্ষতি নয়; এটি ব্যক্তিগত এক বেদনা।”

এই সংকট শুধু একক দেশ বা অঞ্চলের নয়। এটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার সমাধানেও বৈশ্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। কার্বন নিঃসরণ কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমরা এই সংকটের মোকাবিলা করতে পারি।

আমাদের সচেতনতা, সরকারগুলোর দৃঢ় নীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত পদক্ষেপই পারে হিমবাহ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে। সময় এসেছে প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য আরও বড় উদ্যোগ নেওয়ার। অন্যথায়, আমরা শুধু আমাদের সীমান্ত নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যৎও হারিয়ে ফেলব।

Share.
সম্পাদক ও প্রকাশক: INFORMER365TEAM | Email: info@informer365.com
© 2025 Informer 365 বাংলা | Powered by Friday Pixels.
Exit mobile version